মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)

ইমাম বুখারী সংক্ষিপ্ত জীবনীমানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর ভূমিকা অনন্য এবং অমর। তিনি এমন এক সময়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন, যখন সমাজে অবিচার, শোষণ, এবং মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা ছিল চরমে। ইসলামের বার্তা প্রচারের তিনি সমতা ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। 

মানবাধিকার-প্রতিষ্ঠায়-মহানবী-হযরত-মুহাম্মদ-(সা)

প্রিয় পাঠক, দাসমুক্তি, নারীর অধিকার এবং অসহায়দের প্রতি সদয় আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি মানবতার পথিকৃত হয়েছিলেন। তার আদর্শ ও শিক্ষা মানবধিকার প্রথিষ্ঠায় আজও একটি আলোকবর্তিকা স্বরুপ। নিম্নে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নবী (সা) এর ব্যাপারগুলো আলোকপাত হলো।

পেজ সূচীপত্রঃ

সূচনাঃ বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ৯ রবিউল আউয়াল মোতাবেক 22 শে এপ্রিল রোজ সোমবার পবিত্র মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পূর্বে সারা আরব জুড়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সহ সকল ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল। মানুষের জানমালের কোন নিরাপত্তা ছিল না। 

আরো পড়ুনঃ বিনয়-নম্রতা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও নাবী (সাঃ) এর হাদীছ

গোত্রে গোত্রে সামান্য তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাসের পর মাস যুদ্ধ লেগেই থাকতো। এমন সময় মহান আল্লাহ তায়ালা করুনা করে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্ব শান্তি, পরকালীন মুক্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। তিনি হলেন বিশ্ব মানবতা ও শান্তির বাহক। 

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ২১ নং আয়াতে বলেন, "আল্লাহর রাসূলের জীবনের তোমাদের জন্য বাস্তবেই অতি সুন্দর আদর্শ নিহিত রয়েছে।" হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "আমি তোমাদের নিকট শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি।" অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে তোমাদের জন্য শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছেন। অতএব রাসুল সাঃ এর প্রতিটি কথা, কাজ ও আদেশ আমাদের জন্য অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য। 

মানবাধিকার বলতে, যে অধিকার একান্তভাবে মানুষের জন্য তাকেই মানবাধিকার বলে। মানুষ কিছু সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যেগুলো স্বাভাবিক, অপরিহার্য ও চিরন্তন। মানুষ চিন্তা করতে পারে, কথা বলতে পারে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। মানবাধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার প্রাপ্তি, বিশ্ব শান্তি, মানুষের মর্যাদা ও মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। 

এগুলোর সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন হলেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্ম থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত সকল মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণ করেছেন। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো। 

শিশুদের মানবাধিকার

বনলতা'য়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা আম্বিয়ার 107 আয়াত বলেছেন, "হে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।" তিনি হলেন সারা বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ। তিনি কাউকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেন না। তিনি যে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন শিশুকালের একটি ঘটনা উল্লেখ করলে স্পষ্ট বুঝা যায়। 

তিনি দুধ মাতা হালিমার দুধ পান কালে ডান স্তনের দুধ পান করতেন আর বাম স্তনের দুধ দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। বিবি হালিমা শত চেষ্টা করেও বাম স্তনের দুধ পান করাতে পারতেন না। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় তিনি দুধ ভ্রাতার অধিকার সংরক্ষণ করেছেন।

নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে 

হিলফুল ফুযূল গঠনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানবাধিকার 

ফুজ্জারের যুদ্ধ অবসানের পর আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র জুবায়েরের প্রচেষ্টায় আব্দুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে কুরাইশের বনু হাশেম, বনু জোহরা ও তায়মের সকল গোত্র একবাক্যে সঠিক গ্রহণ করেন যে, কোন নিপীড়িতের অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা তার পাশে দাঁড়াবো, তা কি সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করে যাব। 

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শপথ বাক্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন ও শপথ গ্রহণ করেন। এতে বুঝা যায়, শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাঃ এর নবুওয়াতের পূর্বেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিলফুল ফুযুল সম্পর্কে বলেন, "সে সময় আমিও আব্দুল্লাহ ইবনে জুআদানের গৃহে উপস্থিত ছিলাম। 

ওই শপথের পরিবর্তে যদি আমাকে লাল বর্ণের ও উট দেওয়া হতো তবুও আমি অপছন্দ করতাম। এখন ইসলামী যুগেও যদি অনুরূপ একটি শপথ নামা বা চুক্তির জন্য আমাকে আহ্বান করা হয় তাহলে আমি অবশ্যই তা কবুল করব।"

বিবি খাদিজার ব্যবসায়ের মহানবী সাঃ এর অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানবাধিকার 

মক্কায় বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্যশালী মহিলা। তিনি তার ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি খুঁজছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাকে নিজ ব্যবসায় নিযুক্ত করেন। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করেন। এতে পূর্বের তুলনায় অধিক মুনাফা অর্জিত হয়। 

বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দেন। মালিকের মুনাফার অংশ ও মালামাল সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে মহানবী সাঃ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বিবি খাদিজার অধিকার হরণ করেন নেই অর্থাৎ তার ধন সম্পদ আত্মসাৎ ও করেন নাই। 

হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ও বিবাদ মীমাংসার মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বীজ বপন 

কুরাইশগণ কাবা ঘর সংস্কার কালে হাজরে আসওয়াদকে যথাস্থানে স্থাপন করা নিয়ে তাদের মাঝে বিবাদ দেখা দেয়। কোন গোত্র এই মহান গৌরব অর্জন করবে। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব, কলহ ও রক্তপাতের আশঙ্কা দেখা দিল।  অবশেষে প্রবীণ আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরা মাখদুমী বিবাদ মীমাংসার জন্য একটি প্রস্তাব করলেন যে, 

আগামীকাল ভোরের সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি সাফার দিকের দরজা দিয়ে কাবা ঘরে প্রবেশ করবেন তার সিদ্ধান্ত সকলেই মেনে নিবেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম উক্ত দরজা দিয়ে কাবা ঘরে প্রবেশ করেন। তাকে দেখেই এক বাক্যে সকলেই বলে উঠলেন ইনিই হচ্ছেন আল-আমীন বা বিশ্বাসী, আমরা সকলেই তার ফয়সালা মেনে নেব। 

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি চাদর বিছালেন। হাজরে আসওয়াদটি তিনি নিজ হাতে চাদরে রাখলেন এবং প্রত্যেক গোত্রের কতিপয় ব্যক্তি চাদরের বিভিন্ন প্রান্ত ধরে সেখানে নিয়ে গেলেন। এরপর, হযরত মুহাম্মদ সাঃ চাদর থেকে হাজরে আসওয়াদ টিকে যথাস্থানে রাখলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্দর মিমাংসার মাধ্যমে একটা বিরাট সংঘর্ষ ও রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব হলো। সকল গোত্র গৌরব অর্জনের অধিকার লাভ করলেন, এবং এতেও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হলো।

নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম 

মানবাধিকার সংরক্ষণে মদিনার সনদ

মদিনার সনদ পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও এর ভিত্তি স্থাপনে মদিনা চুক্তি একটি অপূর্ব দলিল। মনোবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর আল্লাহ প্রদত্ত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা নিদর্শন মদিনার চুক্তি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুমে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় অবস্থান করেন। 

মদিনায় বসবাসরত বিভিন্ন গোত্র, গোষ্ঠী, দল ও উপদলের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ইতিহাসে মদিনার সনদ নামে খ্যাত। এই চুক্তির ফলে গোত্র সমূহের কলহের অবসান, জুলুম ও অত্যাচার নিষিদ্ধ হয়। এই চুক্তিতে সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। এতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে মদিনা সনদে মানবাধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। 

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয় ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা 

অষ্টম হিজরীর ১০ই রমজান রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিমুখী রওনা হলেন। ১০ হাজার সাহাবী তার সঙ্গে ছিলেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান রাসুল সাঃ এর বিরাট সেনাবাহিনী দেখে ভীত হলেন, শেষ পর্যন্ত জীবনের নিরাপত্তা দাবি করলেন। হযরত আব্বাস রাজি আল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! 

আবু সুফিয়ান মর্যাদাশীল লোক, কাজেই তাকে মর্যাদা দেওয়ার অনুরোধ করছি। মহান উদার ও শান্তির বাহক রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, "যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে আজ সে নিরাপদে থাকবে। আর যে ব্যক্তি নিজের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখবে সে ব্যক্তি নিরাপদে থাকবে। 

আর যে ব্যক্তি কাবা গৃহে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদে থাকবে।" যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আজীবন কষ্ট দিয়েছেন, তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাদের ক্ষমা করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করে নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। 

যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা 

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মহান উদারতা ও সহানুভূতির পরিচয় দিয়েছেন। বদর যুদ্ধ বন্দীদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তা হলো, যুদ্ধবন্দিগণ ১০০০ দিরহাম মুক্তিপণ দেবে, অথবা যারা এটা দিতে অক্ষম তারা মদিনায় দশটি করে শিশুকে শিক্ষা দান করবে। শিক্ষা বিস্তারে রাসুল সাঃ এর অগ্রণী ভূমিকা ছিল বিধায় এমন সুন্দর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এতে মদিনাবাসি শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। 

নারীর অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) 

মহান আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম হযরত আদম আলাইহি সাল্লাম কে সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম আলাই সাল্লাম এর বাম পাঁজর থেকে জীবনসঙ্গিনী হাজরত হাওয়া আলাইহাস সালামকে সৃষ্টি করেন, যাতে তিনি শান্তনা লাভ করেন। সে নারী-পুরুষের মিলিত ধারা থেকে বর্তমানে অগণিত নারী পুরুষ। বর্বরতার যুগে নারী সমাজ ছিল নিগৃহীতা, অবহেলিতা ও লাঞ্ছিতা। স্বামী ও পিতার পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীর কোন অধিকার ছিল না। জন্মই ছিল তাদের আজন্ম পাপ। তারা জীবন্ত কন্যাকে প্রোথিত করে বা পুঁতে ফেলত।

অন্ধকার যুগে অধিকার বঞ্চিতা, অসহায় নারী সমাজ সকল প্রকার নির্যাতন, হয়রানী ও অবমাননার বাঁধন মুক্ত হয়ে যাতে জীবনের সকল ক্ষেত্রে পূর্ণ অধিকার ভোগ করতে পারে সেজন্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, "নারীর উপর পুরুষের যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি পুরুষের উপর নারীর অধিকার আছে।" তিনি বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে তারাই উৎকৃষ্ট যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে।" 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, "মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।" পবিত্র কুরআনুল কারীমের তাদের ন্যায্য মোহরানা প্রদানের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা অবশ্যই কর্তব্য।" পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সালামের অনেক হাদিসেই নারীদের অধিকার আদায়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ সাঃ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম 

মনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক মহান আদর্শ পেশ করে গেছেন। আল্লাহর দেয়া মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী মহানবী সাঃ মদিনা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সুবিচার কায়েম করে এক শোষণহীন, স্বস্তি ও শৃঙ্খলা পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

রাগ ইসলামী যুগে আরব উপদ্বীপে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পঞ্জীভূত হয়েছিল। বৈষম্য ব্যবহারের কারণে দিন দিন আয় ও সম্পদের পর্বত পরিমান ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে বৈষম্য সৃষ্টির কারণগুলির মুলোৎপাটন করেছেন। অতঃপর বৈষম্য আরো রাশ করার জন্য যাকাত, ওশর, সাদাকা, সাদকাতুল ফিতর, হেবা, ওয়াকফ ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। 

এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার 110 নং আয়াতে বলেছেন, "তোমরা সালাত কায়েম করো যাকাত আদায় করো।" সুধীর পরিনাম সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারীমের সূরা বাকারার ২৭৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, "আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।"

অর্থোপার্জনে শ্রমের উপর গুরুত্বারোপ 

রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তার ক্ষমতাও যোগ্যতা অনুযায়ী অর্থ উপার্জন করতে পারে এই জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "কোন মানুষ নিজ হাতে উপার্জন অপেক্ষা অধিক উত্তম খাদ্য খেতে পারেনা।" আত্মার কল্যাণের জন্য হালাল উপার্জন প্রয়োজন। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে বলেন, 

"তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু হতে খাও যা আমি তোমাদের জীবিকা রূপে দান করেছি।" মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা জুমুআর ১০ নং আয়াতে বলেন, "সালাত সমাপ্ত হয়ে গেলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর।" রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন, "সৎ ও বিশ্বস্ত মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহীদের সাথে থাকবেন।" 

ইসলাম ধর্মে হালাল উপায়ে সম্পদ উপার্জনের উপায় সমূহ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন শ্রম, কৃষি কাজ, শিল্প কারখানা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পশুপালন, হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ, বৃক্ষরোপণ, নার্সারি ও কুটির শিল্প ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ আয় করতে পারে। সৎ উপায়ে মুনাফা অর্জন ও শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম 

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মন আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার 135 নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো। আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায় সঙ্গত সাক্ষ্য দান কর। তাতে তোমাদের নিজেদের বা পিতামাতার বা নিকটতম আত্মীয়-স্বজনের ক্ষতি হয় তবুও।" মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদার ৮ নং আয়াতে বলেন, 

"কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে ন্যায় বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার করো এটাই আল্লাহ ভীতির অধিক নিকটবর্তী।" মৌলবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বলতম উদাহরণ রেখেছেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, একবার মাখযূম গোত্রের জনৈকা মহিলা চুরি করে। 

যখন চুরি প্রমাণিত হয় তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত কাটার নির্দেশ দিলেন। মাখযূম গোত্রের লোকজন তাদের বংশের একজন নেতৃস্থানীয় লোকের স্ত্রীর হাত কাটতে সংকোচ বোধ করল। তাই তারা সুপারিশ করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একান্ত স্নেহভাজন হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কে ঠিক করলো। 

তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে এসে মহিলার ব্যাপারে আলাপ করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,"তুমি আল্লাহর দন্ডবিধি অ কার্যকর করতে সুপারিশ করছ?" অতঃপর তিনি মুসলমানদের ডেকে বক্তৃতা দিলেন এবং বললেন, 

"তোমাদের পূর্বে সেসব উম্মত অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এজন্য ধ্বংস হয়েছে যে, নিম্ন শ্রেণীর অপরাধীদের আইন অনুযায়ী শাস্তি দিত, আর উচ্চশ্রেণীর অপরাধীদের ছেড়ে দিত। সেই সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর প্রাণ রয়েছে, মুহাম্মদ সা এর কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করত তবে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।"  

সহীহ মুসলিম ও বুখারী গ্রন্থে রয়েছে, কিয়ামতের দিন সাত প্রকার লোক আল্লাহর আরশের নিচে অবস্থান করবে, তার ভিতর অন্যতম হলো ন্যায় পরায়ণ শাসক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন তা অতুলনীয়। 

বিদায় হজ্বের ভাষণের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা) 

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশম হিজরীর ৯ জিলহজ্জ শুক্রবার আরাফার ময়দানে লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামের সমাবেশে হজের সময় ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ভাষণের অনেক বিষয় রয়েছে এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে আলোচিত হলো। 

হে মানবমন্ডলী! তোমরা দাস-দাসী ও অধীনস্থদের সম্পর্কে সতর্ক হও। তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাদেরকে নির্যাতন করার অধিকার তোমাদের নেই। নিজে যা খাবে ও পড়বে তাদেরকেও তা খাওয়াবে ও পড়াবে। তারা অপরাধ করলে মার্জনা করবে অথবা মুক্তি দান করবে। স্বরণ রেখো, তারাও তোমাদের মত মানুষ ও আল্লাহর সৃষ্টি।

ইসলামে জাতি, শ্রেণী ও বর্ণ বৈষম্য নেই। আরবের উপর যেমন কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই তেমনি কোন অনারবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই আরবের। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র ভিত্তি তাকওয়া ও খোদাভীতি। 

তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্মান ও তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরতরে হারাম করা হলো। যেমন আজকের এই দিন, এই মাস এবং তোমাদের এই শহর সকলের জন্য হারাম, পবিত্র ও নিরাপদ অনুরুপ। 

শুনে রেখো, মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সাবধান আমার পরে তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মতো কুফরী কাজে লিপ্ত হইও না। 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর বিদায় হজের ভাষণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব ও কার্যকারিতা সর্বযুগে ও সর্বকালে প্রয়োজন ও অপরিহার্য।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উপসংহারে কথা

বর্তমান বিশ্বের বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন অজুহাতে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে সাধারণ জনগণকে হত্যা করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এটা অত্যন্ত হতাশা জনক। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে ইসলাম কেন সমর্থন করে না। বাংলাদেশেও কিছু বিপথগামী ব্যক্তি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করে 

আলিম সমাজ তথা ইসলাম ও মুসলমানের সুনাম নষ্ট করছে। কাউকে বিনা বিচারে হত্যার বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদার ৩২ নং আয়াতে বলেছেন, "কেউ কাউকে নর হত্যার অপরাধ ব্যতীত হত্যা করলে সে যেন গোটা মানব জাতিকে হত্যা করল। আর কেউ কারো প্রাণ বাঁচালে সে যেন গোটা মানবজাতিকে বাঁচালো।" 

আরো পড়ুনঃ শায়েখ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উছাইমিনের সংক্ষিপ্ত জীবনী

ফিতনা বা সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ সূরা বাকারার ১৯১ নং আয়াত এ ঘোষণা করেছেন, "ফিতনা বা সন্ত্রাস হত্যার চেয়েও ভয়াবহ।" মহান আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার ৯৩ নং আয়াতে বলেন, "যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে জেনে বুঝে হত্যা করবে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম।" অতএব সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা পরিণত করে এবং জনগণের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করে। 

১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকার সংক্রান্ত সার্বজনীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ঘোষণা পত্র জারি করে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে এই মানবাধিকার গুচ্ছ মৌলিক অধিকার নামে চিহ্নিত হয়েছে। এতে যে সকল মানবাধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে সেগুলো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম ১৪০০ বছর পূর্বেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়িত করেছেন।

অতএব, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও আদর্শ সকলের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণীয়। তিনি হলেন বিশ্বনবী সারা জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকারী। আমীন!  (সংকলিত, গ্রন্থ রাহমাতুল্লিল আলামিন, আর রাহীকুল মাখতুম ইত্যাদি)। 

লেখকের শেষ কথা

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে ব্লগটি লিখা হয়েছে। মহানবী (সা) এর জীবন ও আদর্শ মানবাধিকারের জন্য এক পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত। তার প্রচারিত নীতিমালা শুধু এক সময়ের জন্য নয়, বরং সব যুগে মানুষের জন্য প্রযোজ্য। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং ন্যায় বিচার দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা যায়। 

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তার অবদান শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয়। আজকের বিশ্বে শান্তি এবং মানবিকতার জন্য তার শিক্ষা আমাদের জন্য অনুসরণ করা জরুরী। আরো এমন ব্লগ পেতে সাথেই থাকুন ইনশাআল্লাহ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আব্দুন নূর আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url