যাকাতের হুকুম, শর্ত, খাত, গুরুত্ব ও পরিণাম নিয়ে আলোচনা
হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা যাকাতইসলামের ৫টি মৌলিক ফাউন্ডেশন বা খুঁটির একটি, যেটি ধনী ও দরিদ্রের মাঝে সম্পদের সুষম বন্টন সুনিশ্চিত করে। এটি একটি ধর্মীয় কর্তব্য বা ফারয ফ্যাক্ট যা মাল বা সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর পথে দান করতে হয়।
প্রিয় পাঠক, যাকাত কেবল আর্থিক সহায়তা নয়, বরং এটি সোশ্যাল ব্যালেন্স বা সামাজিক সাম্য ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় এর ভূমিকা অপরিসীম। নিম্নে যাকাতের হুকুম, শর্ত, খাত, গুরুত্ব ও পরিণাম নিয়ে আলোচনা করছি।
পেজ সূচীপত্রঃদারিদ্র বিমোচিত ইসলামের যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। পৃথিবীকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এক, গরিব শ্রেণী। দুই, ধনী শ্রেণী। এর কতগুলো বিশেষ কারণ রয়েছে। নতুবা আল্লাহ ইচ্ছা করলে সমগ্র মানবজাতিকে এক স্তরে সৃষ্টি করতে পারতেন।
কিন্তু তিনি করেননি এর কারণ আল্লাহ সুবহানাহুওয়া বলেন, আমি দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করে দেই এবং তাদের একজনকে অপরজনের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরকে অধীনস্থ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। (সূরা যুখরুফ ৩২)।
আরো পড়ুনঃ কুরআন ও হাদিসের আলোকে ঘুমানোর আদব
এই আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যে, ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য সৃষ্টিগত। যাতে ধনীরা গরীবদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারে, নতুবা সকলেই যদি ধনী হতো তাহলে সুইপার, কুলি, ধোপা, নাপিত ও মজদুর কোথাও পাওয়া যেত না। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ মানব জাতিকে পরীক্ষাও করেছেন। যাতে আল্লাহ যাদের নেয়ামত দিয়েছে তারা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে কিনা এই জন্য?
যাকাতঃ যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, البركة মানে বরকত, النماء মানে বৃদ্ধি, الطهارة মানে পবিত্রতা, الصلاح মানে পরিশুদ্ধতা ইত্যাদি।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, যাকাতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম নাসির উদ্দিন আলবানী বলেন,
الزكاه الشرعا حصة مقدرة من مال مخصوص في وقت مخصص يصرف في جهات مخصوصة
"অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সম্পদে বা (নেসাব পরিমাণ মালে) নির্দিষ্ট সময়ে (চন্দ্র মাস হিসেবে বছর পূর্ণ হলে) নির্দিষ্ট খাতে (কুরআনে বর্ণিত ৮টি খাতে) ব্যয় করার জন্য নির্দিষ্ট অংশ আদায় করার নাম যাকাত।" (সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, আলবানী, ২/৫)।
যাকাতের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের মধ্যে সম্পর্ক , যিনি যাকাত দিবেন যাকাত দেওয়ার কারণে তার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, পবিত্র হবে ও তাতে বরকত হবে। এছাড়া ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, যাকাতের মাধ্যমে যাকাত প্রদানকারীর মন পবিত্র হয় এবং তার সম্পদে বরকত হয় ও বৃদ্ধি পায়। সাথে উহা বালা-মুসিবত থেকেও রক্ষা করে। (মাজমূউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ৫/৪৯২)।
ইসলামের যাকাতের হুকুম বা বিধান
ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী যার উপর যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী পাওয়া যাবে তার ওপর যাকাত ফরজে আইন এবং এটি ইসলামের একটি মহান রুকন। কুরআন, হাদিস এবং ইজমা দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত।
কুরআনের দলিলঃ পবিত্র কুরআনে অসংখ্য স্থানে আল্লাহ তায়ালা যাকাত ফরজ হওয়া এবং তার গুরুত্বের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন, তোমরা সালাত কায়েম করো ও যাকাত দাও। এখানে সালাতের সাথে যাকাত প্রদান করতে আদেশ করা হয়েছে। আরবি এবারত বা আয়াত হচ্ছে,
واقيموا الصلاة واتوا الزكاة
অর্থাৎ, আর তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও।
এখানে সালাতের সাথে যাকাত প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে,
خذ من اموالهم صدقة تطهرهم وتزكيهم بها وصل عليهم ان صلاتك سكن لهم والله سميع عليم
অর্থাৎ, তাদের সম্পদ থেকে সদাকা তথা যাকাত নাও, এবং এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দোয়া করবে যে, নিশ্চয়ই তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (সূরা তাওবা ১০৩)।
অত্র আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যাকাত প্রদানের মাধ্যমে মাল পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়, আর তখন দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত পাঁচটি, যথা -
১) ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া, সুতরাং কোন অমুসলিমের উপর যাকাত ফরজ নয়।
২) স্বাধীন হওয়া, সুতরাং কোন কৃতদাস দাসীর উপর যাকাত ফরজ নয়।
৩) মালিকে নেসাব হওয়া, সুতরাং নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু যথা বসস্থান, পরিধিও বস্ত্র, ঘরের আসবাবপত্র, ব্যবহারের যানবাহন, খেদমতের দাস-দাসী ও সমরাস্ত্র বাদ দিয়ে নেসাবের চেয়ে কম মালের মালিকের উপর যাকাত ফরজ হবেনা।
৪) মালের পূর্ণ দখল থাকা, সুতরাং সরকারিভাবে যে টাকা কেটে রাখা হয় তা হাতে আসার পূর্বে তার ওপর যাকাত ফরজ নয়। টাকা পাবার পর পূর্ব হতে নিসাবের মালিক না থাকলে উক্ত টাকার উপর এক বছর অতিবাহিত হবার পর যাকাত ফরজ হবে।
৫) চন্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিবাহিত হওয়া, সুতরাং এক বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো মালে যাকাত ফরজ হবেনা। তবে জমি হতে উৎপন্ন ফসল ও ফলমূল ছাড়া। এগুলোতে কাটার সময় যাকাত দিতে হবে।
হানাফী মাযহাব অনুযায়ী অতিরিক্ত শর্ত
অন্যান্য ইবাদতের মত যাকাতের ক্ষেত্রেও বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক ও আকিল বা জ্ঞানী হতে হবে। অন্যথায় তার উপর যাকাত ফরজ হবেনা। কেননা শরীয়তের বিধান ফরজ হওয়ার জন্য সাবালক এবং সজ্ঞান হওয়া শর্ত।
কিন্তু অন্যান্য ইমাম, ফক্বীহ ও মুহাদ্দিসিনদের মতে নাবালক শিশুর মালেও যাকাত ফরজ হবে। এ ব্যাপারে ফক্বীহদের দলীল হলো,
عن سعيد بن المسيب ان عمر بن الخطاب رضي الله عنه قال ابتعوا بأموال اليتامى لا تأكلها الصدقة
অর্থাৎ, সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা এতিমের মাল দ্বারা ব্যবসা কর, যাতে যাকাত সম্পদের পুরোটা মাল খেয়ে না ফেলে। (সুনানে বায়হাকী)।
এই হাদিস দ্বারা বুঝা গেল বাচ্চাদের উপর যাকাত ফরজ হবে। অন্যথায় ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর যাকাত আদায় করতে বলতেন না।
হানাফীগণ এই ক্ষেত্রে বর্ণিত হাদিসটিকে দুর্বল বলে আমল করে না। তবে তাদের বক্তব্য সম্পন্ন সঠিক নয়, কারণ এই বিষয়ে তিরমিজিতে বর্ণিত হাদিসটি দুর্বল। কিন্তু আমরা এখানে বাইহাকীতে বর্ণিত হাদিসটি উল্লেখ করেছি যা সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
এছাড়া যে সমস্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা যাকাতকে ফরজ করা হয়েছে সেগুলোতে বলা হয়েছে যাকাত ধনীদের মাল থেকে নেওয়া হবে। ধ্বনি শিশু না বয়স্ক এ ব্যাপারে কোন পার্থক্য করা হয়নি। সুতরাং ব্যাপকভাবে শিশু ও বয়স্ক সকল ধনীদের মাল থেকে যাকাত নেওয়া হবে।
যাকাতের নিসাব
কমপক্ষে যে পরিমাণ মাল থাকলে যাকাত ফরজ হয় তাকে নিসাব বলে। ঋণ ও মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক কে নিসা বলে। হিসাব পরিমাণ মালের কম থাকলে তার উপর যাকাত ফরজ হবেনা। আর নিসাবের চেয়ে বেশি সম্পদ থাকলে তার উপর নিসাব সহ পুরো সম্পদের যাকাত প্রদান করা ফরজ।
যাকাত বিতরণের খাতসমূহ
পবিত্র কুরআনের আলোকে ৮শেনীর লোক যাকাতের মাল পাওয়ার যোগ্য বা হকদার। নিম্নে ৮ শ্রেণীর বর্ণনা দেওয়া হল। যথা-
১. الفقراء বা গরিব সম্প্রদায়
২. المساكين বা অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিবর্গ
৩. العاملين عليها বা যাকাত প্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তি অর্থাৎ যাকাত আদায়কারী।
৪. المؤلفة قلوبهم বা যাদের মন জয় করা যায় ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে তারা।
৫. في الرقاب বা দায়মুক্ত দাস প্রথা যা বর্তমানে চালু নেই, কাজেই দাস থেকে মুক্তির জন্য নির্ধারিত যাকাতের অংশটি অন্যান্য খাতে বিতরণ করা উচিত। কোন কোন আলেম এর মতে ওই সমস্ত যুদ্ধবন্ধীদের জন্য ব্যয় করা উচিত যারা আল্লাহর দীন কায়েম করতে গিয়ে বন্দী হয়েছে।
৬. الغارمين বা ঋণ মুক্তির জন্য বা যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছে।
৭. في سبيل الله বা আল্লাহর পথের যোদ্ধা যারা কুফুরের বাণীকে পদানত করতে এবং আল্লাহর বাণীকে শক্তিশালী ও বিজয় করার জন্য যারা যুদ্ধ করে বা মুজাহিদ বা ইসলামিক যোদ্ধাদের জন্য।
৮. ابن السبيل বা মুসাফির বা পথচারীর জন্য।
যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতি
ইসলামে যাকাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আদায় করা আবশ্যক, আর যারা তা আদায় করবে না, বরং তা অমান্য করবে ও আল্লাহ তা'আলার সীমা অতিক্রম করবে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তি। আর এই শাস্তি প্রথমত দুই ধরনের হতে পারে।
১) ইহকালীন শাস্তি ।
২) পরকালীন শাস্তি।
ইহকালীন শাস্তি আবার দুই রকম, যথা-
১) আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত শাস্তি।
২) ইসলামিক প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রদত্ত শাস্তি।
আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তি ঃ যারা যাকাত আদায় করা থেকে বিরত থাকে এবং তার মালের মধ্য থেকে আল্লাহর হক এবং গরিবের হক আদায় করা থেকে কৃপণতা করে, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তাআলা তাদেরকে দুনিয়াতে অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষতে আক্রান্ত করবেন।
এ সম্পর্কে রাসূল সাঃ এরশাদ করেছেন,
عن بريدة ما منع قوم الزكاة الا ابتلاهم الله بالسين وفي رواية الاحبس عنهم القطر
অর্থাৎ, বুরাইদা রাঃ থেকে বর্ণিত, যখন কোন জাতির যাকাত আদায় না করে, তখন আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টিতে আক্রান্ত করেন। (তাবারানী হা/৪৫৭৭)।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা থেকে নিয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত যাকাত আদায়ের কোন গুরুত্ব দেয় না, এবং তা আদায়ের কোন ব্যবস্থাও নেই। যার ফলে যথাযথভাবে যাকাত আদায় হয় না। আর এ কারণে নেমে আসছে আমাদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নানা ধরনের গজব ও আজাব যার সম্মুখীন হচ্ছি আমরা সকলে।
ইসলামী প্রশাসনের পক্ষ থেকে শাস্তি
যদি তারা ইসলামী সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে তবে তাদের থেকে জোরপূর্বক যাকাত গ্রহণ করতে হবে। কেননা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসুল সাঃ এরশাদ করেন, আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আদিষ্ট হয়েছি
যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, আর সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে। তারা যদি এ কাজগুলো করে, তবে আমার পক্ষ থেকে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল। (সহীহ বুখারী-২৪)।
উল্লেখিত হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম গ্রহণ করার পরেও ইসলামের কোন বিধান অমান্য করার কারণে তার জানমালের নিরাপত্তা বাতিল হতে পারে। আর সেই বিধানের একটি হচ্ছে যাকাত। অথচ ইসলাম অমুসলিমদেরও জানমালের নিরাপত্তা দিয়েছে।
আর যাকাত অনাদায়কারী যদি ইসলামী প্রশাসনের বাহিরে থাকে তাহলে সরকারের দায়িত্ব হল তাদের সাথে যুদ্ধ করা। কেননা সাহাবায়ে কেরামগণ তাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। এ হচ্ছে যাকাত আদায় না করলে তার পার্থিব বা ইহকালীন শাস্তি।
যাকাত আদায় না করলে আখেরাতের শাস্তি
যাকাত আদায় না করলে আখেরাতে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে কুরআন হাদিসে অনেক বর্ণনায় এসেছে যার কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলো। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতালা বলেন,
والذين يكنزون الذهب والفضة ولا ينفقونها في سبيل الله فبشرهم بعذاب اليم - يوم يحمى عليها في نار جهنم فتكوى بها جباههم وجنوبهم وظهورهم هذا ما كنزتم لانفسكم فذوقوا ما كنتم تكنزون
অর্থাৎ, যারা সোনা ও রুপা পুঞ্জিভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আজাবের সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা সেদিন তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেওয়া হবে। (আর বলা হবে) এটা তাই যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ করো। (সূরা আত তাওবা ৩৪-৩৫)।
এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ..... পুঞ্জীভূত সম্পদ হলো ঐ সম্পদ যার যাকাত আদায় করা হয়নি। (আল হাদিস)।
হাদিস থেকেঃ
আবু হুরায়রা রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু পার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে আমি তোমার সম্পদ আমি তোমার জমাকৃত মাল।
তারপর রাসূল সাঃ তিলাওয়াত করলেন, আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে; বরং উহা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরেই কিয়ামত দিবসে যা নিয়ে কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে। (সহীহ বুখারী ২৩৩৯)।
জাহান্নামে যাওয়ার মৌলিক কারণগুলোর অন্যতম হলো যাকাত আদায় না করা
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, জাহান্নামের রক্ষীরা বলবে কিসে তোমাদেরকে (পাপীদেরকে) জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করালো? তারা বলবে আমরা সলাত আদায়কারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না আর আমরা অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করতাম না। (সূরা মুদ্দাছছির ৪২-৪৫)।
ইসলামী শরীয়তের যাকাতের গুরুত্ব ও অবস্থা
যাকাত ইসলামের পঞ্চবেনার একটি। ঈমান এবং নামাজের পরেই যাকাতের স্থান। কোরআনে বহু জায়গায় সালাত এবং যাকাতকে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষেরা মুখে মুখে বলে, নামাজ রোজা কিন্তু কোরআন হাদিসে নামাজের সাথে রোজাকে মিলানো হয় নাই, বরং বলা হয়েছে সলাত যাকাত। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ রহস্য রয়েছে।
তা হল সালাতে যখন আমির ফকির, ধনী-দরিদ্র, একত্রে দাঁড়াবে তখন ধনীরা গরীবের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবে এবং তাদেরকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ হবে। এ কারণে ইসলামের সালাত এবং যাকাতের গুরুত্ব মানুষের সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ কারণে কোরআন হাদিসের সালাতের পরেই যাকাতের উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে এরশাদ হয়েছে,
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর একাত্মতা ঘোষণা করা, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমজানের সিয়াম পালন করা এবং হজ্জ করা। (সহীহ মুসলিম হা/১৯, বোখারী হা/৮, তিরমিজি হা/২৬০৯)।
যাকাতের এই গুরুত্বের কারণেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম (রা) থেকে যাকাতের জন্য বিশেষভাবে বাইয়াত নিতেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাঃ এর নিকোর্ট সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কল্যাণকামী হওয়ার ব্যাপারে বাইয়াত দিলাম। (সহীহ বুখারী হা/১৪০৮)।
যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ
যারা যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করবে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাসূল সাঃ কে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যুদ্ধ করার নির্দেশ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
فان تابوا واقاموا الصلاه واتوا الزكاة فاخوانكم في الدين
অর্থাৎ, অতএব যদি তারা তাওবা করে এবং সালাত আদায় করে ও যাকাত প্রদান করে, তবে দীনের মধ্যে তারা তোমাদের ভাই। (সুরাত তওবা আয়াত/১১)।
এ আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যাকাত আদায় না করলে তারা আমাদের মুসলিম ভাই হতে পারে না। এ কারণেই হাদিসে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য যে শর্তগুলো রয়েছে তার মধ্যে যাকাত অন্যতম।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম আল্লাহর রাসূল, আর সালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে।
রাসূল সাঃ এর ওফাতের পর আবু বকর রা মুসলিম জাহানের খলিফা নিযুক্ত হলেন। তখন নানা প্রকার সমস্যা সৃষ্টি হলো, ভন্ড নবীর আবির্ভাব, মুরতাদ হওয়া বা নিজ ধর্ম ত্যাগ, কাফিরদের যুদ্ধ প্রস্তুতি, মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র,
যাকাত দিতে অস্বীকার এবং এই ধরনের আরো নানাবিধ সমস্যার মধ্যে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সর্বপ্রথম যার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করলেন সেটা হচ্ছে যাকাত দিতে অস্বীকারকারী। এখান থেকে বুঝা যায় যে যাকাত আদায় করার গুরুত্ব অপরিসীম। (সহীহ বুখারী হা/৬৪৫৬)।
যাকাত আদায় করলে আমাদের লাভ
১) যাকাত দাতার দানে মালের পরিশুদ্ধ হয়।
আল্লাহ বলেন, তাদের সম্পদ থেকে সদাকাহ বা যাকাত নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দোয়া কর, নিশ্চয়ই তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক। (সূরা তাওবা /১০৩)।
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, যাকাত দিলে যাকাত প্রদানকারী পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়। পবিত্র অবস্থায় যেমন সকল প্রকার এবাদত বন্দেগী করলে কবুল হয়, ঠিক যাকাত দিলে তার আর্থিক পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা আসে, যার ফলে দোয়া করলে কবুল হয়। আর যাকাত না দিলে নবীর দোয়াও তাদের জন্য কবুল হবে না।
২) যাকাত দাতার মাল বৃদ্ধি পায়।
হযরত আবু হুরায়রা রা বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের পবিত্র বা হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করল, (আর জেনে রেখো) আল্লাহর কাছে পবিত্র জিনিসই গৃহীত হয়। আল্লাহ তায়ালা ওই দান কে নিজের ডান হাতে কবুল করেন।
অতঃপর উহাকে দানকারীর জন্য লালন পালন করতে থাকেন, যেভাবে তোমাদের কোন এক ব্যক্তি বকরির বাচ্চাকে লালন পালন করে, অতঃপর উহা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়। সহীহ মুসলিম এর বর্ণনায় আছে, পাহাড়ের চেয়েও বেশি হয়। (সহীহ বুখারী হা/৭৪২৯, মুসলিম হা/২৩৯০)।
বুঝা গেল, যাকাত দাতা তার সামান্য মাল থেকে যদি যাকাত বের করে আর তা যদি হালাল হয় তবে আল্লাহ তার যাকাতের নেকিকে বৃদ্ধি করতে থাকবেন, এমনকি সেটি পাহাড় বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি করবেন।
যাকাত দাতাকে আল্লাহ জান্নাত দান করবেন
কোরআনে যাকাত প্রদান করা জান্নাত বাসীদের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই মুত্তাকীরা থাকবে জান্নাত সময়ে ঝর্ণাধারায়, তাদের রব তাদের যা দিবেন তা তারা খুশিতে গ্রহণ করবে। ইতিপূর্বে এরাই ছিল সৎকর্মশীল। রাতের সামান্য অংশেই এরা ঘুমিয়ে কাটাতো। এরা রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকতো। আর তাদের ধনসম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক। (সূরা যারিয়াত আয়াত ১৫-১৯)।
অর্থাৎ যারা তাদের মাল থেকে ব্যয় করে আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দান করবেন। জেতার মালের হক হকদেরকে পৌঁছে দিবে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে জান্নাত দান করবেন। ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম, এর মাধ্যমে সমাজ হতে বিভিন্ন দুর্যোগ নিরসন হয়।
রাষ্ট্রে বলে ইসলামী অর্থনীতি যাকাত ব্যবস্থা চালু হলে সমাজ হতে চুরি, ডাকাত, ছিনতাই, নারী নির্যাতন এবং বিশেষত সুদের মতো জঘন্য অপরাধের অবসান ঘটবে।
আরো পড়ুনঃ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)
এ রূপে আরো নানান অপরাধ সমাজ হতে অপসারিত হবে যদি যাকাত ব্যবস্থা চালু হয়। কেননা সমাজে এ সমস্ত অপরাধ গুলি সংঘটিত হয় আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। এবং এ যাকাত অনাদায়ের কারণে সমাজে মানুষের মধ্যে ধনী গরিবের এক বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।
যদি সুপরিকল্পিতভাবে এই যাকাত আদায় করা এবং বন্টন করা হতো তাহলে পৃথিবীতে ধনীর দরিদ্রের এই বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হতো না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন, আমীন!
লেখকের শেষ কথা
যাকাতের হুকুম, শর্ত, খাত, গুরুত্ব ও পরিণাম নিয়ে আলোচনা করেছি আজকের ব্লগটিতে। সম্মানিত পাঠক মহোদয়, যাকাত কেবল একটি আর্থিক দায়িত্ব নয়, এটি মানবিক উন্নয়নের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি ধনী ও দরিদ্রের মাঝে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
যাকাতের বাস্তবায়ন ইসলামী অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করে এবং সমাজ থেকে দারিদ্র দূর করে। এর হুকুম, শর্ত ও খাত সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনে প্রতিটি মুসলিমের জন্য আবশ্যক ও কর্তব্য। আরো এমন বিষয় জানতে সঙ্গেই থাকুন ইনশাআল্লাহ।
আব্দুন নূর আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url