হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহি.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

ইমাম ত্বহাবী (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনীহযরত ইমাম গাজ্জালী (রহি.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে আজকের ব্লগটি জুড়ে থাকছে বিবরণ। ইমাম গাযালী কে কেউ গাযযালী বা গাজ্জালী এ রকম শব্দভেদে ও বলা হয়ে থাকে। 
হযরত-ইমাম-গাজ্জালী-(রহি.)-এর-সংক্ষিপ্ত-জীবনী
প্রিয় পাঠক, আপনিও যদি ইমাম গাযালীর মত একজন জ্ঞান পিপাসু ও অজানাকে জানা এবং অদেখা দেখার আগ্রহী একজন কৌতহলী মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে নিম্নে তাঁর জীবনী টি পড়ে দেখুন। এক্ষেত্রে, আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না যে তিনি কেমন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন? 

পেজ সূচীপত্রঃ

ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহর পরিচিতি 

এই বিশ্ব বরেণ্য মহা মনীষীর নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ। তার পিতা ও পিতামহ উভয়েরই নাম মুহাম্মদ। তার মর্যাদা সূচক পদবী হচ্ছে হুজ্জাতুল ইসলাম। খোরাসানের অন্তর্গত তুস জেলার তাহেরান নগরে গাজালা নামক স্থানে হিজরী ৪৫০ সন মোতাবেক ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  

আরো পড়ুনঃ হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর জীবনী (পর্ব-১)

ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহির যুগে পারস্যের সম্রাট ছিলেন সলজুক বংশীয় সুলতান রূকন উদ্দিন তোগরোল বেগ। সলজুক বংশীয় সুলতানগণের রাজত্বকাল মুসলমানগণের চরম উন্নতির যুগ ছিল। তাদের পূর্বে ইরান শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত বুইয়া বংশীয় রাজাদের শাসনাধীন ছিল। এ সময় মুসলিম শক্তি সমূহ পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ, আক্রমণ প্রতি-আক্রমণের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। 

কিন্তু সলজুক বংশীয় তুর্কিগণ ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের প্রাক ইসলামিক স্বভাব চরিত্র ও মূল্যবোধে আমূল বিবর্তন সাধিত হয় এবং তাদের মাধ্যমে এক অনুপম সভ্যতা গড়ে ওঠে। ফলে তারা মুসলিম বিশ্বের লুপ্ত প্রায় শক্তি ও প্রতিভাকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হয়। এ শক্তির অভ্যুদয়ের কারণে খ্রিস্টান শক্তির অগ্রগতি রহিত হয় এবং সমগ্র এশিয়ার এক বিরাট অংশ এই সুলতানগণের আওতায় এসে পড়ে। 

এই যুগে মুসলিমদের বিদ্যার জন স্পৃহা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। সেই সময়ে প্রচলিত ইহুদী, খ্রিস্টান এবং পারসিকদের জ্ঞান অর্জন সমাপ্ত করে প্রাচীন গ্রিক, মিশরীয় ও ভারতীয় জ্ঞানাহরনে তারা প্রবৃত্ত হয়; এজন্যই জ্যোতিষ শাস্ত্র, জ্ড়বাদ, নাস্তিকতা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার মতবাদের সংমিশ্রনে মুসলমান সমাজে বহু মতানৈক্যের সূত্রপাত হয় এবং ইসলামী আকাইদ ও জ্ঞানের সাথে নানাবিধ মারাত্মক অইসলামিক ধর্ম বিশ্বাস ও জ্ঞান এমনভাবে মিশে পড়ে যে খাঁটি ইসলামের আকিদা ও অইসলামী আকিদার পার্থক্য করায় দূরূহ ব্যাপার হয়ে ওঠে। 

অত্যন্ত পরিমাণে পার্থিব জড় জ্ঞানের প্রভাবে ধর্ম জ্ঞানের শ্বাস প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং মুসলিম সমাজে আকাইদ ও ধর্ম কর্মের ক্ষেত্রে এক চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। এ থেকে সমাজকে রক্ষার দায়িত্বই হযরত ইমাম গাজ্জালী রাহমাতুল্লাহি এর উপর অর্পিত হয়। এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের অতুলনীয় প্রতিভা যে নিপুনতার সাথে এই দায়িত্ব সমাপন করেছে যে সমগ্র বিশ্ব তার জন্য বিস্ময় ও ভক্তি আপ্লুত হৃদয়ে তাকে কেয়ামত পর্যন্ত স্মরণ করবে। 

তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা 

সেই সময়ে মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রাথমিক স্তর হইতে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ছাত্র গনের খাওয়া পরার খরচসহ মাদ্রাসার সমস্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করত। সাথে সাথে সকল মসজিদ ও সংগতি সম্পন্ন লোকদের ঘরেও বহু বেসরকারি মাদ্রাসার ব্যবস্থা ছিল। দূর দেশীয় ছাত্রদের ভরণ পোষণ এবং যাবতীয় ব্যয় ভার আমিরগণ বহন করতো। 

সুতরাং সেই সময়ের শিক্ষার পথ ধনী নির্ধন সকলের জন্যই অত্যন্ত সুগম ছিল। প্রবীণ এবং উচ্চ শিক্ষিত সুধীজন যেসকল স্থানের শিক্ষা দান করত সেসব স্থানই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হতো। এই জন্য অতি সহজে জ্ঞান পিপাসা নিবারণ করতে পারা খুব সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল।

শিশুকাল ও জ্ঞান অন্বেষণ জীবন 

ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহির বাবা ছিলেন দরিদ্র, তারপরেও তিনি ছেলের শিক্ষার জন্য চেষ্টা করে ত্রুটি করেন নাই। ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাই অতি শৈশব কালেই বাবাহীন হয়ে যান। অন্তিম কালে তার পিতা তার জনৈক বন্ধুর উপর দুই ছেলে আহমদ ও মোহাম্মদের লালন-পালন এবং শিক্ষার ভার অর্পণ করেন এবং এজন্য সামান্য অর্থ প্রদান করেন। 

শিশুদ্বয় অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পবিত্র কোরআন হেফজ সমাপ্ত করে তারা শহরের এক মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে অধ্যায়ন শুরু করেন। আল্লামা আবু হামিদ আসকারায়েনী আল্লামা আবু মোহাম্মদ জুবায়নি ইত্যাদি মহাজ্ঞানী শিক্ষকদের নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন। খ্যাততনামা ফিকহ শাস্ত্রবিদ আল্লামা আহমদ বিন মুহাম্মদ রাযকানির নিকট প্রাথমিক কিতাব সমূহ অধ্যায়ন করেন। 

উন্নত শিক্ষার জন্য জুরজান যাওয়া

তাহেরান শিক্ষা সমাপ্তির পর গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাই ক্লাবের জন্য  জুরজান শহরে গমন করেন। এখানে তিনি হযরত ইমাম আবু নছর ইসমাইল রহিমাহুল্লাহ এর তত্ত্বাবধানে শিক্ষা গ্রহণ আরম্ভ করেন। তার তীক্ষ্ণ মেধা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে সন্তান স্নেহে সর্বশক্তি প্রয়োগে তিনি তাকে শিক্ষাদানে ইচ্ছা পোষণ করলেন। 

সে সময়ে শিক্ষকগণ পাঠ্য বিষয়ে যে বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করতেন তা শিক্ষার্থীকে তা হুবহু লিখতে করে নিতে বাধ্য করতেন। এই লিখিত নোটগুলোকে তা'লিকাত বলা হয়। এভাবে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহি তা'লিকাতের এক বিরাট দপ্তর সঞ্চয় করলেন। 

তাহেরানায় গমনকালে পথিমধ্যে সর্বস্ব ছিন্তাই  

জুরজানের অধ্যয়ন সমাপন করে ইমাম গাজ্জালী জন্মভূমি তাহেরান অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে দস্যু দল তালিকাডসহ তাহার যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন বা জোর করে কেড়ে নিলেন। টাকা পয়সা এবং পোশাক পরিচ্ছদ হারিয়ে গেলে তিনি কোন পরোয়া করলেন না। কিন্তু তা'লিকাতের অপহরণে তিনি অত্যন্ত দুঃখ পাইলেন। 

এগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য দস্যু সরদারের নিকট তিনি এই বলে অনুরোধ জানালেন যে উহাতে তাহার সমস্ত অর্জিত বিদ্যা সঞ্চিত রয়েছে। দস্যু সরদার ঠাট্টা ছলে বলল তুমি তো বেশ বিদ্যা অর্জন করেছ! সবই কাগজে রয়েছে, মনে কিছুই নাই। একথা বলে সে তা'লিকাত ফিরিয়ে দিল। সরদার ব্যঙ্গের কথাটা ইমামের  মনে দাগ কাটলো। অনন্তর অল্প দিনের মধ্যেই সমস্ত তা'লিকাত তিনি মুখস্ত করে ফেললেন।

নিজামিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা

খোরাসানের অন্তর্গত নিশাপুরে অবস্থিত নিজামিয়া মাদ্রাসা সে সময়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। জুরজানের অধ্যয়ন শেষ করে গাজালি রহমাতুল্লাহ আলাইহি এর জ্ঞান আহরণ পিপাসা নিবৃত্ত হলো না। তাই তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসায় গেলেন এবং সেখানে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমরুপে স্বীকৃত ইমামুল হারামাইন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন এই মাদ্রাসার প্রধান অধ্যক্ষ। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ হতে বহু লোক উচ্চশিক্ষার জন্য তার নিকট ছুটে আসতো। 

তিনি এত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে গোটা দুনিয়ার সুলতান গুলো জটিল বিষয়ের মীমাংসার জন্য তার নিকট উপস্থিত হতো এবং তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হতো। ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহি উপযুক্ত শিক্ষক পাইয়া তার তীব্র জ্ঞান পিপাসা মিটাতে লাগলো। ইমামুল হারামাইনও ইমাম গাযালী সাহেবকে দর্শন ও জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে খুব আগ্রহের সাথে শিক্ষা দিতে লাগলো। 

৪৭৮ হিজরীতে ইমামুল হারামাইন ইন্তেকাল করলেন। তিনি ছাত্রদলের নিকট এত প্রিয় ছিলেন যে তারা তার ইন্তিকালে পাগল প্রায় হয়ে পড়ল। কেউ বা বহুদিন যাবত শিশুর ন্যায় গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করতে লাগলো। তার ৪০০ ছাত্র ছাত্রীর সকলেই নিজ নিজ দোয়াত কলম ভেঙে ফেলল এবং জামে মসজিদের মেম্বার ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। 

কারণ এগুলোর সাথে তাদের প্রিয় ওস্তাদের স্মৃতি বিজড়িত ছিল এবং এগুলো তাদের হৃদয়ের শোকের আগুনকে আরো প্রজ্বলিত করে তুলছিল। ছাত্ররা প্রায় এক বছর সময় ওস্তাদের শোকে নীরব হয়ে থাকলো। ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহি এর নিকট ওস্তাদের ইন্তেকাল যার পর নাই অসহনীয় হয়েছিল এবং নিশাপুর তার নিকট অন্ধকার পুরীর ন্যায় মনে হতে লাগলো। তাই তিনি নিশাপুর ত্যাগ করে বাগদাদে চলে গেলেন। 

এই সময়ে হযরত গাজী রহমাতুল্লাহ আলাইহির বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। তিনি জানতেন যে কেবল কিতাব পাঠ আল্লার জ্ঞানের জন্য যথেষ্ট নয়, ইহার জন্য দিব্য জ্ঞান সম্পন্ন জীবন্ত ওস্তাদ বা শিক্ষকের নিতান্ত প্রয়োজন। তাই তিনি সেই সময়ের প্রখ্যাত পীরে কামেল হযরত শেখ আবু আলী ফারমেদী রহমাতুল্লাহ আলাইহির হাতে বায়াতপূর্বক তার মুরিদ হয়ে যান। 

মাদ্রাসা নিজামিয়ার প্রধান শিক্ষকের পদে ইমাম গাজ্জালী রহ.

বাগদাদে তখন তুর্কি রাজ মালেক শাহের আধিপত্য ছিল। তার প্রধানমন্ত্রী হাসান বিন আলি নিজামুল মুলক একজন অসাধারণ পন্ডিত ও বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন। তার নামানুসারেই বাগদাদের বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসায়ে নিজামিয়া এবং তাহার পাঠ্য তালিকা দরসে নিজামী নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি কে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। 

তখন তার বয়স মাত্র ৩৪ বছর, এত অল্প বয়সেও তিনি অধ্যাপনা ও পরিচালনা কাজে নিতান্ত দক্ষতা ও নিপুণতার পরিচয় প্রদান করেন। সংবাদ বাদশা এবং রাজপুরুষ গুলো রাজ কাজের জটিল সমস্যা সমূহে তারপর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এসময় তার নাম দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন দেশ হতে শত শত ছাত্র তার ছাত্রত্ব গ্রহণের জন্য ছুটে আসে। মাদ্রাসা নিজামিয়ার খ্যাতি ও অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপনার সাথে সাথে তিনি নানা জটিল বিষয়ে গবেষণাও করতে থাকেন। এভাবে তিনি অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী হয়ে উঠেন। 

মাদ্রাসার নিজামিয়া ছেড়ে  

অত্যন্ত জোশ ও যোগ্যতার সাথে ইমাম গাজ্জালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি চার বছর যাবত মাদ্রাসার নিজামিয়াতে কাজ করেন। একাধিক জটিল বিষয়ের চমৎকার ব্যাখ্যা শুনে এবং তার জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করে তার ছাত্রগণ একেবারে বিস্মিত হয়ে পড়তো। এখানে অবস্থানকালে তিনি দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের গ্রন্থরাজি অধ্যায়ন সমাপ্ত করেন। তারপরেও তার মন পরিতৃপ্ত হইতো না। 

এ কিসের অভাবে যেন তার মন আনচান করতে লাগলো। অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। যাবতীয় কাজের প্রতি তার মন বিত্তৃষ্ণু হয়ে উঠলো। তিনি ব্যাকুল ভাবে বুঝলেন যে কেবল পুঁথিগত জ্ঞান দ্বারা বিশেষ কোনো কাজ হয় না, বিশুদ্ধ জ্ঞান এর সাথে সাথে একাগ্র সাধনা এবং কঠোর রিয়াযতেরও দরকার রয়েছে। 

এ সম্পর্কে তিনি স্বয়ং বলেন, মানুষের সৎ গুণগুলো বিকাশের জন্য অক্লান্ত ও সাধনা এবং একনিষ্ঠ সংযমের একান্ত প্রয়োজন। এই অনুভূতির পর নিজের স্বভাব এবং কাজের প্রতি মনোনিবেশপূর্বক দেখলেন যে তার কোন কাজেই এই নীতির অনুরূপ নয়; যার দ্বারা তার স্বভাব, আত্মা এবং মানবতার উন্নতি সাধন হতে পারে। তিনি আরো বুঝতে পারলেন যে তিনি প্রবৃত্তির বশীভূত হয়ে কাজ করছে এবং একমাত্র আল্লাহ সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তার কোন কাজ হচ্ছে না। 

তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য লোকালয়ে অবস্থান করে দুনিয়ার সকল মোহ বর্জন করতে হবে। এভাবে চিন্তা করতে করতে যাবতীয় কাজের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ও বৈরাগ্য ভাব জন্ম হতে লাগলো। মাদ্রাসার অধ্যাপনা এবং পরিচালনার কাজেও শিথিলতা দেখা দিল, প্রায় সময় নিরব ভূমিকায় থাকল, হজম শক্তি কমতে লাগলো এবং ঔষধেও অনিচ্ছা পোষণ হতে লাগলো। ডাক্তারগুন বললেন, এ অবস্থায় কোন ঔষধ ফলপ্রদ হবে না। 

অনন্তর দেশ ভ্রমণে বাহির হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো। দেশের নেত্রী স্থানীয় লোকেরা, আলেম-ওলামা, সুধীজন এবং রাজপুরুষগণ এই ইচ্ছা পরিত্যাগের জন্য তাকে অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু তিনি মনকে বশে আনতে পারলেন না। শেষমেষ সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে হিজরী ৪৮৮ জনের জিলকদ মাসে তিনি গোপনে সিরিয়ার দিকে রওনা হলেন। 

হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাই এক অসাধারণ অনুসন্ধিৎস্য মন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাগতিক জ্ঞান তার মনের তীব্র পিপাসা নিভাতে পারে নাই। তাই তিনি এবার আধ্যাত্মিক জ্ঞানের খোঁজে বের হয়ে পড়লেন। শিশুকাল থেকেই তার ধর্মের প্রতি অনুরাগ এবং জ্ঞানপিপাসা ছিল অত্যন্ত প্রবল। পূর্ব ও পশ্চিমের সকল দার্শনিকের মতবাদ ও গভীর মনোযোগ সহকারে তিনি অধ্যায়ন করেন। 

কিন্তু এতে তার মনের জিজ্ঞাসার কোন সঠিক জবাব তিনি খুঁজে পেলেন না। তাই এক অজানা রহস্যের সন্ধানে সংসারবিরাগী সুফি দরবেশের বেশে জীবনের দীর্ঘ ১০ টি বছর নানা দেশ ঘুরে তিনি অতিবাহিত করেন। এ পথেই তিনি তার চির আকাঙ্ক্ষিত রহস্যের সন্ধান খুঁজে পান। তার মন চির রহস্যময় আল্লাহর স্বরূপ উদঘাটনে সমর্থ হয় এবং তার অন্তরের পিপাসা নিবারিত হয়। 

বলা হয়ে থাকে যে, মাদ্রাসা নিজামিয়াতে অবস্থানকালে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাই মূল্যবান পোশাক পরিচ্ছেদ পরিধান করতেন। কিন্তু উদ্দেশ্য ঘোরার সময় তিনি অত্যন্ত সাধারণ পরিচ্ছদে একটি মোটা কম্বল-সম্বল জড়িয়ে বের হন। কিন্তু তাতেও তাকে খুব আনন্দিত দেখাইত। সিরিয়ার পথে তিনি কিছুকাল দামেশক শহরের অভ্যন্তরে উমাইয়া জামে মসজিদে অবস্থান করেন। 

সে সময় এ মসজিদের পাশে একটি বিরাট মাদ্রাসা ছিল। হযরত ইমাম গাজ্জালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এই মসজিদের পশ্চিম দিকে অবস্থিত মিনারার এক প্রকোষ্ঠে নিজ বাসস্থান নির্ধারণ করেন এবং অধিকাংশ সময়ই এখানে মোরাকাবা মুশাহাদায় নিমগ্ন থাকেন। 

অবসর সময়ে তিনি কিছু সংখ্যক অতি আগ্রহী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতেন এবং সময় সময়ে আলেমগণের সাথে জটিল বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করতেন। 

বাইতুল মুকাদ্দাস গিয়ে নির্জন বাস অবলম্বন 

দুই বছর দামেস্ক নগরে অবস্থানের পর তিনি বায়তুল মাকদিস গমন করেন। এর কারণস্বরূপ বর্ণিত আছে যে তিনি একদা নিজ প্রকোষ্ঠ হতে বের হয়ে মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায় গেলেন এবং এর প্রধান শিক্ষকের সাথে কোন বিষয়ে আলোচনায় ইচ্ছা পোষণ করলেন। আলোচনার সময় শিক্ষক সাহেব এ সম্পর্কে বলেন ইমাম গাজ্জালী এভাবে লিখেছে। 

এ প্রশংসা তার মনে অহংকারের সৃষ্টি করতে পারে ভেবে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহি সেখান থেকে সংগোপনে বায়তুল মাকদাসে চলে যান এবং সেখানে তিনি সাখুরাতুস সাম্মা নামক বিখ্যাত পাথরের নিকটবর্তী এক নির্জন প্রকোষ্ঠে অবস্থান করতে থাকেন। তিনি সেখানে সর্বদা জিকির ফিকিরে মশগুল থাকতেন এবং সময় সময় নিকটবর্তী পবিত্র মাজারসমূহ জিয়ারত এর জন্য বের হতেন। 

মাকামে খালীলে তিনটি প্রতিজ্ঞা 

বাইতুল মাকদাসের জিয়ারত শেষ করে তিনি মকামে খলিল নামক স্থানে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের মাজার জিয়ারতে গমন করেন। আর সেখানে তিনি তিনটি প্রতিজ্ঞা করেন, ১. কখনো কোন রাজ দরবারে যাব না, ২. কোন বাদশাহের বৃত্তি বা দান গ্রহণ করবো না, ৩. এবং কারো সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হব না। 

বাইতুল মাকদার সে অবস্থানকালে ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি অনেক সময় মসজিদে আকসায় আল্লাহর এবাদত ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। 

পবিত্র মদিনা জিয়ারত বা সাক্ষাৎ  

বাইতুল মাকদাস থেকে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাই পবিত্র মদিনা গমন করলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা মোবারক জিয়ারত করেন এবং কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। 

হজ্জ সমাপ্তি ও দেশ ঘুরা  

পবিত্র মদিনা থেকে তিনি মক্কাতুল মোকাররমা গমন করলেন এবং পবিত্র হজ্জ পালন করেন। সেখানেও  তিনি দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। মক্কা মদিনায় অবস্থানকালে তিনি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের বহু বুজুর্গের সাথে সাক্ষাৎ ও আলাদা আলোচনা করেন। তারপর সেখান থেকে তিনি বিশ্ব বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া পরিদর্শনে গমন করেন। সেখানে কিছু কাল যাবত অবস্থানের পর দেশে ফিরে আসেন।

ফেরার পথে তিনি আবার পবিত্র মক্কা-মদিনা জিয়ারত করেন। বাগদাদ থেকে বের হয়ে সুদীর্ঘ ১০-১১ বছর কাল তিনি বহু বন-জঙ্গল, জনপদ এবং মরুপ্রান্তর ভ্রমণ করেন। বলা আবশ্যক যে সে সময়ে যাতায়াতের জন্য বাহন পশু ব্যতীত অন্য কোন উপায় ছিল না। 

কিন্তু এত কষ্টকর ভ্রমণীয় তার এবাদত বন্দেগী ও রিয়াজত-মুজাহাদায় কোন প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি হয় নাই। ফলে তার অন্তরাত্মা সম্পূর্ণরূপে নির্মল ও পরিষ্কার হয়ে পড়ে এবং দিব্য জ্ঞানের পথে সমস্ত পর্দা একেবারে অপসারিত হয়ে যায়। 

পুনরায় মাদ্রাসা নিজামিয়ার মুহতামিমের পদ 

হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি উপলব্ধি করলেন যে সমগ্র দুনিয়া ধর্মের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে এবং মুসলিমগণ ধর্মে কর্মে দিন দিন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। জড়বাদী দর্শন-বিজ্ঞানের ঝড়-ঝঞ্চার সংঘাতে ধর্মের সূত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ছে। এজন্য নির্জন বাস পরিত্যাগ করে তিনি ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগের ইচ্ছা করলেন। 

বাগদাদ অধিপতি সুলতান মালেক শাহের ছেলে সুলতান সানজার সালজুকীর প্রধানমন্ত্রী ফখরুল মুলক এই সময় আবার মাদ্রাসা নিজামিয়ার অধ্যক্ষ পদ গ্রহণের জন্য গাযালী রহমতুল্লাহি কে অনুরোধ করেন। নির্জন বাস ছেড়ে দিয়ে ধর্ম শিক্ষা প্রসারের কাজে মনোনিবেশ করার জন্য তার বন্ধুবান্ধবগুলোও তাকে পরামর্শ দিতে থাকেন। 

এছাড়া স্বপ্নযোগেও বহু পবিত্র আত্মা তাকে এই পরামর্শই প্রদান করেন। সুতরাং দেশে ফিরে হিজরী ৪৯৯ সালের জিলপদ মাসে পুনরায় তিনি মাদ্রাসা নিজামিয়ার অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করে যথারীতি ধর্ম শিক্ষা কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিরে অতিশয় উৎসাহ উদ্দীপনের সাথে এই কাজ আঞ্জাম দিতে থাকেন।

ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহির মাদ্রাসা নিজামিয়া বর্জন করা  

হিজরী ৫০০ সালের মহররম মাসে প্রধানমন্ত্রী ফখরুল মুলক এক দুরাচার গুপ্তঘাতকের হাতে শহীদ হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার অনতিকাল পরেই গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাই মাদ্রাসার নিজামিয়া ছেড়ে দিয়ে নিজ বাসভবন এর অনতি দূরে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে এলমে দীনের শিক্ষার্থী ও আল্লাহর পথের পথিকগণকে শিক্ষা দিতে থাকেন। বাকি জীবন তিনি এই স্থানে এবং এই কাজে কাটিয়ে দিলেন। 

হিংসার রোষাণলে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহি

মাদ্রাসার নিজামিয়ার অধ্যক্ষ পদ পূর্ণ গ্রহণের জন্য বাগদাদ অধিপতি সুলতান সানজার suzuki ইমাম গাজ্জালিকে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু তাতে তিনি রাজি হন নাই। এই সুযোগে হিংসা পরায়ন কতিপয় লোক তার বিরুদ্ধে সুলতানকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা চালায়। সুলতান হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিল। 

তারা তার নিকট অভিযোগ করলো যে, মনখুল কিতাবে ইমাম গাজ্জালী ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ আলাইহিকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। এতে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ এর প্রতি সুলতানের অসন্তোষের উদ্রেক হয়। রাজদরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ এর উপর নির্দেশ দেওয়া হয়। 

তা অনুযায়ী তিনি দরবারে উপস্থিত হলে সুলতান দাঁড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করেন এবং তাকে সিংহাসনে বসান। হযরত ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ আলাইহির বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি সত্য নয়। তার সম্বন্ধে আমার সেই বিশ্বাসী সাবেত রয়েছে। তাকে আমি ফিক্বহ শাস্ত্রের জোক শ্রেষ্ঠ ইমাম বলে স্বীকার করে। এতে সুলতানের ধারণা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন হয়ে গেল।

নিজামিয়া মাদ্রাসার মুহতামিমের পদ পুন:গ্রহনের অনুরোধ অস্বীকৃতিজ্ঞাপন  

ফেরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাই মাদ্রাসার নিজামিয়া ছাড়ার পর এর যশ গৌরব কমতে থাকে। তা পুনরুদ্ধারের জন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং রাজ পুরুষগণ বিভিন্ন উপায়ে তাকে তার অধ্যক্ষ পদে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু নিম্নলিখিত কারণে তিনি তা গ্রহণে অসম্মতি জানায়। 

১. কৃষ্ণনগরে বর্তমানে আমার নিকট দেড়শ ছাত্র পড়ছে, আমি বাগদাদে চলে গেলে তাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া দুঃসাধ্য হবে।

২. পূর্বে আমার কোন সন্তান ছিল না, কিন্তু এখন আল্লাহ তাআলা কয়েকটি সন্তান দান করেছেন, তাদেরকে ছাড়া বাগদাদে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। 

৩. মাকামে খলিলে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, ভবিষ্যতে আর কোন প্রকার বিতর্কে লিপ্ত হবো না কিন্তু বাগদাদে তা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোন গত্যন্তর নেই।

৪. খলিফার সম্মানার্থে তার দরবারে উপস্থিত হতে হবে আমার এটা সহ্য হবে না। 

৫. রাজ দরবার থেকে কোন বেতন বা বৃত্তি গ্রহণ করব না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। বাগদাদে আমার কোন সম্পত্তি নেই, সুতরাং কিভাবে আমি সেখানে অবস্থান করব? 

মোটকথা সর্বপ্রকার অনুরোধ সত্বেও তিনি উক্ত অধ্যক্ষ পদ গ্রহণে আর সম্মত হন নাই। জীবনের অবশিষ্ট অংশ তিনি তুষ নগরেই কাটিয়ে দেন। 

কিতাব বা গ্রন্থ লেখায় ইমাম গাজ্জালী রহঃ

জ্ঞানের আলো বিতরণের উদ্দেশ্যে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহির মরজগতে আবির্ভাব। বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারে যে অবদান তিনি রেখে গেছেন তা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। এই মহা মনীষী মাত্র ৫৫ বছর জীবিত ছিলেন। শিশুকাল এবং পড়ার জীবন ছাড়া মাত্র ৩৪ থেকে ৩৫ বছর কর্মজীবনে তিনি প্রায় ৪ শত অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। 

তার ভিতর 'ইয়াকুতুততাবলীগ' নামক তাফসির ৫০ খন্ডে বিভক্ত এবং ইয়াহিয়াউল উলূম বিরাট চার খন্ডে সমাপ্ত করেন। প্রত্যেকটি খন্ড আবার দশটি পৃথক অংশে বিভক্ত। ১০-১১ বছর আবার তিনি দেশ পর্যটন ও নির্জন বাসে অতিবাহিত করেন। তদুপরি অধ্যাপনা, অধ্যায়ন, ধ্যান-সাধনা ও ইবাদত বন্দেগীতে প্রত্যহ কিছু সময় ব্যয় করতেন। 

তার দরবারে শিক্ষার্থী ও দীক্ষা প্রার্থীদের সংখ্যা কোনদিনই দেশতের কম হতো না। এছাড়া বহু দূর-দূরান্ত থেকে নানা জটিল বিষয় নিয়ে ফাতওয়ার জন্য অনেক লোক তার দরবারে আগমন করত এবং ওয়াজ-নসিহত ও বিতর্ক সভা ও তাকে করতে হতো। এতেও কম সময় ব্যয় হতো না। এতসব কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি এতগুলো গ্রন্থ রচনা করে অসাধারণ প্রতিভারি পরিচয় দিয়েছেন। 

আল্লামা নববী রহ. বলেন যে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহির সম্পূর্ণ আয়ুষ্কাল তথা জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত এবং তার রচিত গ্রন্থ গুলির হিসাব শেষে আমি গড় করে দেখেছি তিনি গড়ে প্রত্যেকদিন ১৬ পৃষ্ঠা করে লিখেছেন।

দর্শন, তর্ক, এলমে কালাম, ধর্মতত্ত্ব মনস্তত্ত্ব স্বভাব বিজ্ঞান, নীতি বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। 

তার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, 

ফিকাহ যথা- ওয়াসীত, বাসীত, ওয়াজীয, বয়ানুল কাওলায়নি শিশু শাফেয়ী, তা'লীক্বাতুন ফি ফুরুয়িল মাযহাব, খুলাসাতুর রাসায়িল, ইফতিসার, মুখতাসার, গাওয়াতুল গাওর, মজমুআতুল ফাতাওয়া ইত্যাদি। 

ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি যথা- তাহসীনুল মাখায, শিফাউল আলীল, মুনতখাল ফি ইলমিল জিদলি, মনখুল, মসতাসফা, মাখায় ফিল খিলাফিয়্যাত, মুফাসসালুল খিলফি ফি উসুলিল কিয়াস ইত্যাদি।

মানতিক যথা- মিয়ারুল ইলমি, মিজানুল আ'মাল প্রভৃতি। 

দর্শন যথা- মাকাসিদুল ফালাসিফা যা ইউরোপে সংরক্ষিত। 

ইলমি কালাম যথা- আহাতাফুল ফালাসিফা, মুনকিয, ইলজামুল আওয়াম, ইকতিসাদুস মোস্তাজহারী, ফাজায়েহুল ইযাহিয়্যাহ হাকিকাতুতুররুহ, কিস্তাসুল মোস্তাকিম, কাউলুল জামিল ফি রাদদিন আলা মান গায়্যারাল ইঞ্জিল, মাওয়াহিবুল বাতিনিয়্যাহ, তাফাররাকাতুম বায়নাল ইসলামী ওয়াল জিন্দিকাহ, আর রিসালাতুল কুদসিয়্যাহ।

আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিষয় যথা - 

ইহয়াউল উলূম, কিমিয়ায়ে সাদাত, আল মাকসুদুল আকসা, আখলাকুল আবরার, যাওয়াহিরুল কুরআন, জওয়ায়হিরুল কুদসী ফি হাকিকাতিন নাফস মিশকাতুল আনওয়ার, মিনহাজুল আবেদিন, মি'রাজুস সালিকিন, নাসিহাতুল মূলক, আইয়ুহাল ওলাদ, হেদায়াতুল হেদায়া, মিশকাতুল আনওয়ার ফি লাতায়িফিল আখয়ার। 

নিশাপুর অবস্থানকালে ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি গ্রন্থাদি রচনা শুরু করেন। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের যে জড়বাদ বিশেষত গ্রিক দার্শনিকদের ভ্রান্ত দার্শনিক মতবাদ মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে প্রবেশ লাভ করেছিল, এই সময়েই তিনি অতি সুন্দর ও সুক্ষ যুক্তিপূর্ণ বিচারে এসব দোষ ত্রুটি চালিয়া বাচিয়া ফেলে দিয়ে মনখুল (এর অর্থ চালনি দ্বারা চালা) গ্রন্থ রচনা করেন। 

প্রথম জীবনের লেখা হলেও এটি সুধীজনের উচ্চপ্রশংসা অর্জন করে। এমনকি তার ওস্তাদ স্বয়ং হযরত ইমামুল হারামাইন র. পর্যন্ত এই গ্রন্থ পাঠ করে মন্তব্য করেন যে, জীবদ্দশায় তুমি আমাকে মেরে ফেললে। অর্থাৎ ছাত্রের খ্যাতি ওস্তাদের জীবদ্দশায় তার খ্যাতিকে অতিক্রম করে গেল। 

তা রচিত গ্রন্থা গুলির মধ্যে এহিয়াউল উলূম ইসলাম জগতে বিশেষ ভাবে সমাদৃত। সুধীজন এর উচ্চ প্রশংসা করেছেন। এ সম্পর্কে শিশু স্থানীয় কতিপয় মনীষীর উক্তি এই যে, জগতের সমস্ত জ্ঞান প্রদীপ নিভিয়া দিলে কেবল ইয়াহিয়া উল উলূম দ্বারা পুনরুদ্ধার করা যাবে। ইয়াহিয়ার পূর্বে রূপ গ্রন্থ জগতে আর লেখা হয় নাই। ইয়াহিয়া কুরআন মাজিদের নিকটবর্তী গ্রন্থ। 

জগত বিখ্যাত সিদ্ধ পুরুষ হযরত গাজালি রহমাতুল্লাহ আলাইহি একদা এক বিরাট জনতাকে সম্বোধন করে বলেন যে আমার হাতে কোন গ্রন্থ তোমরা জানো কি? ইহা এহিয়াউল উলূম। গ্রন্থখানাকে অবজ্ঞা করার কারণে আমার বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে অভিযোগ করা হয়। স্বপ্নযোগে দেখলাম বিচারে আমার পিঠে চাবুক মারা হয়েছে। এই দেখো আমার পিঠের চাবুকের চিহ্ন বিদ্যমান। 

তার রচিত 'মাকাসিদুল ফালাসিফা' ও 'তাহাফুতুল ফালাসিফা' প্রভৃতি দর্শন শাস্ত্রের কিতাব সমূহ ইউরোপের সমদ্রিত হয়েছে, এবং ইংরেজি, ফরাসি, ল্যাটিন, হিব্রু ইত্যাদি ভাষায় এগুলির অনুবাদ প্রকাশ হয়েছে। এই সকল গ্রন্থ ইউরোপীয় বহু বক্রপন্থী পন্ডিতের জ্ঞানচক্ষু সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। জনৈক্য ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেন, ইমাম গাজ্জালী ও ইবনে রুশদের জন্য না হলে মুসলমানগণ নিউটন ও অ্যারিস্টোটলের জাতি হয়েই থাকতো। 

বস্তুত পাশ্চাত্যের জড়বাদী ভ্রান্ত দার্শনিক মতবাদের মোকাবিলায় খাঁটি দর্শনকে বলিষ্ঠ যুক্তিতে প্রকাশ করে হযরত ইমাম গাজ্জালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিশ্ব মানবের মূল্যবোধ ও চিন্তা ধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনায়ন করেন। বিশেষত আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও চিন্তা ধারাকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে তিনি মানব ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। 

মুসলিম বিশ্ব অপেক্ষা খ্রিস্টান ইউরোপে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহির গ্রন্থাবলী সমাদৃত বেশি। প্রখ্যাত কবি  দান্তে, মনীষী রেমণ্ড মার্টিন, মনীষী সেন্ট টমাস একুইনাস, প্রখ্যাত ফরাসি মিষ্টিক ব্লেইসি পেস্কেল ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর গ্রন্থরাজি হতেই তাদের যুক্তি ও উদাহরণ গ্রহণ করেন এবং তার মতামত কেই প্রামাণ্য বলে উল্লেখ করেন। তার ৪০ টি গ্রন্থ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। 

'কিমিয়ায়ে সাদাত' হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহির অপর একখানি অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থ। দুনিয়ার প্রায় সকল ভাষায় এই মূল্যবান গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বাম শহরে ল্যাটিন ভাষায় এটি সর্বপ্রথম অনূদিত হয় এবং অধ্যাপক হিথজীন এর কঠিন শব্দ সমূহের ভাষ্য রচনা করেন। 

শোকের ছায়া 

সোমবার, মাহে জমাদিউল উখরা, হিজরী ৫০৫ সাল মোতাবেক ১৯ শে ডিসেম্বর, ১১১১ খ্রিষ্টাব্দে ফজরের নামাজ সমাপ্ত করে সমগ্র বিশ্বের বিস্ময়কর প্রতিভা যুক্তি ও যুক্তিবাদী ও প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিক বিশ্ব মানবতার দিশারী শফিকুল শিরোমনি ও শিরোভভূষণ হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম আবু হামিদ মুহাম্মদ গাজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৫৫ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে সুখ সাগরে ভাসিয়ে রফিকের সান্নিধ্যে উপনীত হযন। সম্পূর্ণ সুস্থ শরীরেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

তার তিরোধান সম্পর্কে তাঁর ভাই হযরত ইমাম আহমাদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি বলেন, সোমবার দিন অতি সকালে বিছানা ত্যাগ করে তিনি সব সিদ্ধ অভ্যাস অনুসারে ওযু করে ফজরের নামাজ সমাধা করেন। তার পূর্বে প্রস্তুত করা তাহার কাফনটি চেয়ে নিলেন এবং এটি চোখে স্পর্শ কর বললেন প্রভুর আদেশ চিরো ধার্য। কথাটি মুখ হতে নিঃসৃত হওয়ার সাথে সাথে তিনি স্বীয় পদদয় প্রসারিত করলেন এবং সেই মুহূর্তেই আল্লাহ তাআলার নিকট প্রাণ সমর্পণ করে দিলেন। 

মানবতা বা মনুষ্যত্বের শেষ কোথায়  

হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি নেই ধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ এবং আল্লাহকে উপলব্ধি করার জন্য রহস্যের প্রতি এমন উন্মাদনা জগতে অতি অল্প ব্যক্তির মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। জীবনের সুখ দুঃখ এবং জাগতিক সব প্রলোভনের মায়া কাটিয়ে তিনি একমাত্র আল্লাহর ধ্যানে বিমগ্ন থাকতেন। আত্মাও সৃষ্টিকর্তার গোপন রহস্য উদঘাটনে তার সাধনার অনন্ত ছিল না। 

আরো পড়ুনঃ ইমাম বুখারী সংক্ষিপ্ত জীবনী জেনে নিন কয়েক সেকেন্ডে

তা সম্পর্কে তিনি যে জ্ঞান লাভ করেন তা যেমনই পূর্ণাঙ্গ গভীর তেমনি অভিনব। এ জ্ঞানের আলোক জগতের পথভ্রষ্ট মুসলমান আবার তাদের সঠিক পথের সন্ধান লাভ করে। তার বলিষ্ঠ যুক্তি ও অভ্রান্ত মতবাদের নিকট পূর্ববর্তী দার্শনিকগণের সকল চিন্তাধারাম ম্লান  হয়ে পড়ে। বিগত ৮ শতাব্দী যাবত তার দর্শনে সারা জাহানের মুসলমানের দিকদর্শন যন্ত্র রূপে তাদের মানসিক জগতকে পরিচালনা করে আসছে। 

তার প্রতিভা ও দর্শনে বিমুগ্ধ হয়ে বাস্তব জীবনে তার মত ও পথ অবলম্বন করলেই বিশ্ব মানবতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, সমগ্র বিশ্বে এক ও অভিন্ন, সুন্দর ও সুষম মানব সমাজ গড়ে উঠবে। মনে হয় সেদিন খুব দূরে নয়। ___(সৌভাগ্যের পরশমণি)।

ব্লগের শেষ কথা

হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহি.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় উক্ত ব্লগটিতে তুলে ধরা হয়েছে। প্রিয় পাঠক, ইমাম গাযযালী আসলে একজন সত্যিকার সত্য অনুসন্ধানী ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তার লেখা বইগুলো দেখলে বুঝা যায় তিনি কোন স্তরের ও পর্যায়ের উচ্চ প্রতিভা ও মেধার অধিকারী ছিলেন। যার কারণে অমুসলিমরা পর্যন্ত তার পুস্তিকাগুলো গবেষণা সহকারে অধ্যায়ন করে। আরো ব্লগ পেতে আব্দুন নূর আইটির সাথেই থাকুন ইনশাআল্লাহ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আব্দুন নূর আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url