হাদীছ অস্বীকারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর জীবনীহাদীছ অস্বীকারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়ে জানা সকল মুসলিমের দরকার। কারণ যুগে যুগে এমন অনেক বিষয় ও ঘটনা ঘটে গেছে যেগুলো আপনি না জানলে আপনিও এক সময় এর শিকার হতে পারেন।
সম্মানিত পাঠক, আপনি যদি নিজের ঈমানকে সেইফ বা নিরাপদ রাখতে চান তাহলে যুগে যুগে যে হাদিস উপহাসকারীর ইতিহাস গুলো ঘটে গেছে সেগুলো জেনে নিজে সতর্ক থাকতে হবে এবং নিজের আপনজনদেরকে সিকিউর্ড রাখতে হবে, তাহলে পরকালে মুক্তি মিলবে ইনশাআল্লাহ। নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে হাদিস অস্বীকারের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করছি।
প্রেজ সূচিপত্র:হাদীছ অস্বীকারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভূমিকাঃ এক হাদীসে রয়েছে, 'হাসান বলেন, এক সময় ইমরান বিন হুসাইন রা: আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদেরকে হাদীস শোনাচ্ছিলেন। তখন তাকে এক ব্যক্তি বলল, হেয আবু নুজাইদ! আমাদেরকে কোরআন শুনাও! তখন ইমরান বিন হোসাইন রা: বললেন, তুমি কি মনে কর তুমি এবং তোমার সাথীরা কোরআন পড়ে আমাকে স্বর্ণ, উট, গরু এবং সম্পদের যাকাতের পরিমাণ সম্পর্কে জানাতে পারবে?
আরো পড়ুনঃ ইমাম ত্বহাবী (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী জানুন
অতঃপর ইমরান বললেন, নিশ্চয়ই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতের এই ফরজ করেছেন। তখন সে ব্যক্তিটি বলল, হে আবু নুজাইদ! তুমি আমাকে বাঁচিয়েছো, আল্লাহ তোমাকে বাঁচাক'। (আল -মু'জামুল কাবির হা/৩৬৯; মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৩৭২)।
তাহক্বীক বা বিশ্লেষণ: এই হাদিসে হাসান বাছরী রা: ইমরান বিন হুসাইন রা: থেকে শ্রবণের বিষয়ে 'স্পষ্ট শব্দ' ব্যবহার করেছেন। সুতরাং এর সনদ মুদ্দাসিল বা সংযুক্ত এর সকল রাবী ছিক্বহ বা মজবুত।
আরো একটি হাদিস, 'উমাইয়া বিন আব্দুল্লাহ এক সময় আব্দুল্লাহ বিন উমর রা: কে লক্ষ্য করে বলেন, আমরা মুক্বীম বা বাড়িতে থাকা অবস্থার সালাত এবং ভীতিকর পরিস্থিতির সালাত আল কুরআনুল মাজীদে পাই, কিন্তু সফরের সালাতের কথা কুরআন কারীমে পাইনা। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, হে আমার ভাতিজা!
মহান আল্লাহ আমাদের নিকট মুহাম্মদ (সা) কে পাঠিয়েছিলেন, যখন আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা মুহাম্মদ (সা) কে যে কাজ যেমনভাবে করতে দেখেছি ঠিক তাই করি'। (সহীহ ইবনে খুযায়মা হা/৯৪৬; মুস্তাদ রাকে হাকেম হা/৯৪৬)।
তাহক্বীক - বিশ্লেষণ: হাদীছটির রাব্বী বা সকল বর্ণনাকারী ছিক্বহ বা মজবুত, আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর ব্যতীত। চিনি হাসান পর্যায়ের রাবী বা বর্ণনাকারী।
উপরের দুই হাদিসের দুর্ঘটনা প্রমাণ করে যে, স্বয়ং সাহাবায়ে কেরামের যুগেই এমন কিছু অজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল, যারা শুধু কুরআন যথেষ্ট এই সন্দেহে পতিত হয়েছিল। এ ফিতনা তত বিস্তার লাভ করেছে যত সময় গড়িয়েছে।
তাইতো আইয়ূব আস-সাখতিয়ানি রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, যখন তুমি কাউকে হাদিস শোনাও এবং সে বলে যে ছাড়ো এসব! আমাদেরকে কোরআন শোনাও, তখন জেনো যে, সে নিজে পথভ্রষ্ট এবং অন্যকে পথভ্রষ্টকারী। (খতিব বাগদাদী, আল আলফিয়া ১/১৬।
তাহক্বীক বা বিশ্লেষণ: এই হাদিসের সকল রাবী বা বর্ণনাকারী ছিক্বহ বা মজবুত।
উছমান (রা) এর হত্যার পর সমগ্র ইসলামী খেলাফতে ফিতনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ফিতনায় খারিজি ও শিয়া ফিরকা বা দল দুটির আবির্ভাব ঘটে, যার প্রভাব হাদিসের উপর পড়তে শুরু করে। শিয়ারা শুধুমাত্র আলে বায়াতের হাদিস গ্রহণ করতে শুরু করে। খারিজিরা যে সমস্ত সাহাবীকে কাফের মনে করত, তাদের হাদিস গ্রহণ করা ছেড়ে দেয়।
হাদিস অস্বীকার করার এ ফিতনা সবচেয়ে বিস্তার লাভ করে মু'তাযিলা ফিরকা বা দলের মাধ্যমে। তারা হাদিসের উপর বিবেককে প্রাধান্য দেওয়া শুরু করে। এমনকি খাবারে ওয়াহেদ হাদীছকে দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য মনে করে না।
উল্লেখ্য যে, ডক্টর মোস্তফা আল আজমি তার 'দিরাসাত ফিল হাদিস আন নাবাবি' নামক বইয়ে বর্ণনা করেন যে, ইসলামের কোন ফিরকা বা দলই সরাসরি হাদিস অস্বীকার করেনি। ইসলামী শরীয়তর দ্বিতীয় উৎস হিসাবে হাদিস সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তারা নিজেদের মত ও মাযহাব বিরোধী হাদিসগুলো বাতিল করার জন্য বিভিন্ন অসৎ পন্থা ও মূল নীতি অবলম্বন করে!
সম্পূর্ণরূপে হাদিস অস্বীকার করার দু একটা উদাহরণ কাকতালীয়ভাবে পাওয়া গেলেও তা তৃতীয় শতাব্দীকাল আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যায়। হাদিস সরাসরি অস্বীকার করার ফিতনা ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিগত কয়েক শতাব্দীতে জন্ম নেয়। ( মোস্তফা আল আজমি, দিরাসাত ফিল হাদিস আন নাবাবি ২২-২৫)।
আধুনিক যুগে হাদিস অস্বীকার
আআধুনিক যুগে হাদিস অস্বীকার মূলত প্রাচ্যবিদদের দ্বারা প্রভাবিত একজন মুসলিম স্কলারের হাতে হয়। যার কেন্দ্র বলা হয় ভারত ও মিশর। মিশরের মুফতি আব্দুল্লাহ, সৈয়দ রশিদ রেজা, ডঃ আহমদ আমিন ও মাহমুদ আবু রাইয়ার হাতে এ ফিতনা অঙ্কুরিত হয়। এদের মধ্যে মাহমুদ আবু রাইয়ার আক্রমণ সবচেয়ে নিকৃষ্ট ছিল। সে তার আযওয়া আল আস সুন্নাহ নামক বইয়ের মধ্যে সাহাবী আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এবং হাদিসে রাসূল বিষয়ে বিষোদগার করেছে।
সৈয়দ রশিদ রেজা আল্লাহর অশেষ রহমতে তার পূর্বের অবস্থান থেকে ফিরে আসেন এবং তার হাদিস বিরোধী আল মানার পত্রিকা হাদিসের পক্ষে বিরাট ভূমিকা পালন করে। ডক্টর আহমদ আমিন ফজরুল ইসলাম, যুহাল ইসলাম এবং যুহরুল ইসলাম এই তিনটি বইয়ের মধ্যে হাদিসে সন্দেহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন।
আরব বিশ্বের নামকরা সাহিত্যিকদের মধ্যে ইসলামের ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে যে সবচাইতে নগ্ন হামলা চালিয়েছে, সে হলো মিশরের অন্ধ সাহিত্যিক ও সমালোচক ডক্টর তোহা হোসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ উম্মাহাতুল মুমিনের ওপর নির্লজ্জের মত হামলা চালিয়েছে সে।
অন্যদিকে ভারতে, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠাতা ইংরেজ কর্তৃক স্যার উপাধি প্রাপ্ত সৈয়দ আহমদ খান এ ফিতনার উত্থান ঘটায়। সে কুরআন হাদিসের চাইতে মান্তিক এবং যুক্তিবাদের ওপরে অধিক নির্ভর করেছে। তার লিখিত তাফসীর গ্রন্থে সে মো'জেযা সংক্রান্ত ঘটনাগুলোকে ও ও অস্বীকার করে সেগুলো র তা'বিল বা মনগড়া ব্যাখ্যা করেছে। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মৌলবি চেরাগ আলী, আব্দুল্লাহ চকরালবীসহ আরো অনেকে।
পাশাপাশি সৈয়দ রশিদ রেজার মত ইসলামের হিতাকাঙ্খী একদল স্কলার রাসূল সাঃ এর হাদিস নিয়ে সংশয়ে ভুগতে থাকে। তাদের কিতাবে হাদিস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। বর্তমানে হাদিস অস্বীকার নামক ভয়ানক ফিতনার অন্যতম একটা অংশ হলো নাস্তিকতা। তথাকথিত যুক্তি ও বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে হাদিসকে পরীক্ষা করতে গিয়ে মুহাদ্দিসগণ এবং সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে,
বিশেষ করে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে নিয়ে ঠাট্টা করার মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু হয়। একপর্যায়ে সেই ঠাট্টা সরাসরি হাদিস এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে শুরু হয়ে যায়। (ওয়াল ইয়ার বিল্লাহ)।
হাদিস অস্বীকারের স্বরূপ
হাদিসকে ইসলামের শত্রুরা যেমন সরাসরি অস্বীকার করেছে, তেমনি ইসলামের নামে বিপ্লব সৃষ্টিকারীদের জবান ও কলম থেকেও হাদিসের পবিত্র আঁচল রক্ষা পায়নি। নামধারী কিছু মুসলিম ছলে বলে কৌশলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর হাদিস কে পাস কাটিয়ে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করেছে। তাদের কিছু অপকৌশল নিম্নে পেশ করা হলো।
১. মুতাওয়াতির হাদিস ব্যতীত সব হাদিস বিশেষ করে খবরে ওয়াহেদকে দলিলযোগ্য মনে না করা।
২. হাদিসটা কিকের ক্ষেত্রে মহাদ্দিসগণ যেসব উসুল বা মূলনীতি অবলম্বন করেছেন, সেগুলিকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করা।
৩. নিজের খোঁড়া যুক্তি, বুদ্ধি বিবেক এবং কি আজকে হাদিসের উপর প্রাধান্য দেওয়া।
৪. হাদিস এবং সুন্নাতের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করা।
৫. সালাফিস সালেহীনের ব্যাখ্যা থেকে সরে গিয়ে হাদিসের এমন ভাবে তাবিল বা দূরতম ব্যাখ্যা করা, যাতে হাদিসের আসল উদ্দেশ্যই হারিয়ে যায়।
৬. বিভিন্ন মূলনীতির বেড়াজালে ফেলে হাদিসকে অচল ও অকেজো করে দেওয়া।
এছাড়া আরো অনেক অপকৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন সময় নামধারী অনেক মুসলিম আমাদের প্রাণপ্রিয় মহান রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর মুখনিঃসৃত বাণীকে অমান্য করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।
মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান কোরআনে আছে
বাস্তবের কোরআনে মানব জীবনের সকল সমাধান দেওয়া হয়েছে। কোরআন মাজিদেই মহান আল্লাহ মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধানের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ কে আমাদের ওপর ফরজ করে দিয়েছেন। তার জীবনকে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ বলেছেন।
আরো পড়ুনঃ হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহি.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
সুতরাং কোরআন মানবজাতির যে সকল সমস্যার সমাধান গুলো দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি সমাধান হচ্ছে রাসূলকে অনুসরণ করা। অতএব কোরআন তার দাবিতে মিথ্যা নয়।
লেখক এর শেষ মন্তব্য
হাদীস অস্বীকারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয়টি আমরা আজকের ব্লগে তুলে ধরেছি। প্রিয় পাঠক, হাদিস যারা অস্বীকার করে তারা বিভিন্ন খোঁড়া দলিল ও যুক্তি পেশ করে, যেগুলো তাদের নিজের মন গড়া এবং যুক্তি নামে অযৌক্তিক বিষয়। আপনি যদি একজন খাঁটি মুসলিম ও মুমিন হতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে কোরআন মানার সাথে সাথে হাদিস কে মানতে হবে।
কারণ কোরআন হচ্ছে হাদিসের ব্যাখ্যা স্বরূপ। যেটা আল্লাহ সুবাহানাহুওয়া তা'য়ালা নিজেই কুরআন মাজিদের মধ্যে বলেছেন। তাই আপনি কোরআন মানলে হাদিস মানতে বাধ্য। আরো এমন ব্লগ বা আর্টিকেল পেতে সাথেই থাকুন ইনশাআল্লাহ।
আব্দুন নূর আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url