কুরআন ও হাদিসের আলোকে ঘুমানোর আদব
কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে মহান আল্লাহর অস্তিত্বকুরআন ও হাদিসের আলোকে ঘুমানোর আদব সম্পর্কে আজকে লিখতে চলেছি। ঘুম অত্যন্ত আরামদায়ক সম্পদ মানুষের জন্য। ঘুম নেই যার সে বুঝে কী নাই তার জীবনে। কুরআনে ঘুমকে মানুষের শান্তি ও স্বস্তি এবং মানষিক প্রফুল্লতার জন্য তৈরী করা হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, ঘুম যেমন আরামদায়ক তেমন এটিকে আরামদায়ক করতে কিভাবে ঘুমালে এটি আরাম পাওয়া যাবে তার আদব বা বৈশিষ্ট্য আছে। জেনে রাখতে হবে ঘুমকে কুরআনে ছোট মৃত বলা হয়। নিম্নে ঘুমের আদাব সম্পর্কে লিখা হলো।
পেজ সূচীপত্রঃভূমিকাঃ
আল্লাহ তাআলা নিজ রহমতে আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন রাত ও দিন। রাত এবং দিন তাঁর নির্দেশাবলীর অন্যতম নিদর্শন। এ মর্মে আল্লাহ তা'আলা,
و من رحمته جعل لكم الليل والنهار لتسكنوا فيه ولتبتغوا من فضله ولعلكم تشكرون
অর্থাৎ, তিনি তার নিজের রহমত বা করুনায় তোমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ এবং শান্তি পাও, এবং তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো। (সূরা ক্বাসাস আয়াত/৭৩)।
এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন যে,
وجعلنا نومكم سباتا
অর্থাৎ, আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূর কারি। (সূরা নাবা আয়াত/৯)। ঘুম হলো মৃত্যুর ভাই বা অপর নাম। মানুষ যখন ঘুমায় তখন সে মরে যায়। আল্লাহ তাআলা আবার জাগ্রত করেন বলেই আমরা জানতে পারি।
আরো পড়ুনঃ বিনয়-নম্রতা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও নাবী (সাঃ) এর হাদীছ
এজন্য ঘুমানোর সময় রাসূল সাঃ শেখানো তরিকা বা পদ্ধতি অনুযায়ী ঘুমানো উচিত, যাতে করে ওই রাত্রে মৃত্যু হলে আমাদের মৃত্যুটা ভালো মৃত্যু হিসেবে গণ্য হয়। তাই এ মর্মে একটি আর্টিকেল লেখা জরুরী মনে করে আজকে আর্টিকেলটি লিখতে বসলাম। নিচে ঘুমানোর আদব প্রসঙ্গে আলোচনা করছি।
এশা সালাতের পর তাড়াতাড়ি ঘুমানো
এশা সালাতের পর আমাদেরকে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে।
ان النبي صلى الله عليه وسلم كان يكره النوم قبل صلاة العشاء والحديث بعدها
অর্থাৎ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশা সালাতের পূর্বে ঘুমানো এবং এশা সালাতের পর কথা বলা অপছন্দ করতেন। (বুখারী হা ১/১৪৯ ও তিরমিযী)।
তবে এলেমের চর্চা করা, মেহমানদের সাথে কথা বলা এবং স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা যায়।
ওযু করে ঘুমানো
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজু করে ঘুমাতেন এবং রাসুলুল্লাহ সাঃ বারা ইবনে আযেব রঃ কে বলেন -
اذا اتيت مضجعك فتوضأ وضوءك للصلاه
অর্থাৎ, যখন তুমি ঘুমাবার জন্য বিছানায় যাবে তখন অজু করবে যেভাবে সালাতের জন্য অজু করো। (বুখারী, আবূ দাঊদ হা/৫০৪৬)।
নরম বিছানায় না ঘুমানো
নরম বিছানায় ঘুমানো যাবে না, তাতে ঘুম বেশি হয় এবং অলসতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে অনেক কল্যাণকর জিনিস হতে মাহরূম বা বঞ্চিত হতে হয়। রাসূল সাঃ এর বিছানা ছিল শক্ত।
عن عائشه رضي الله عنها قالت كانت وسادته التي تنام عليها بالليل من ادم حشوها ليف
অর্থাৎ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ যে বিছানায় ঘুমাতেন তার বালিশটা ছিল শুকনো চামড়ার যার ভরার ছিল শুকনো ঘাসের বা খেজুরের খোসার। (আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
উমর রাঃ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি রাসূল সাঃ এর নিকট উপস্থিত হলাম এবং দেখলাম তিনি একটা চাটায়ের উপর শুয়ে রয়েছেন এবং তার শরীরে একটি চাদর ছাড়া কিছুই ছিল না। আরো আমি লক্ষ্য করলাম তার শরীরের চাটা এর চিহ্ন বাদ দাগ। (বুখারী)।
উল্লিখিত হাদিস দুটি দ্বারা বুঝা গেল যে রাসূল সাঃ বিছানা ছিল শক্ত।
ডান পাশে কাত হয়ে শয়ন করা
রাসূলুল্লাহ সঃ বারা ইবনে আযেব রঃ কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হে বারা ইবনে আযেব! যখন তুমি ঘুমাবে ডান কাত হয়ে ঘুমাবে।
عن حفصة قالت كان النبي صلى الله عليه وسلم اذا اخذ مضجعه جعل يده اليمنى تحت خده الايمن
অর্থাৎ, হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিছানায় যেতেন, তিনি তার ডান হাতকে ডান গালের নিচে রেখে ঘুমাতেন। (সহীহুল জামে' ইমাম আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন)।
ডান পাশের ওপর ঘুমানোতে অনেক উপকারিতা রয়েছে
ডান পাশে ঘুমালে অনেক অসুখ হতে বাঁচা যায়, বিশেষ করে ডানপাশে ঘুমালে হার্ট বা হৃদরোগ হবে না। আর বাম কাঁধের উপর ভর করে ঘুমালে ঘুম বেশি হয়। এজন্য ডাক্তারগণ বাম কাঁধের উপর রোগীদের ঘুমাতে বলেন।
আর ডান কাঁধে ঘুমালে ঘুম কম হয় যেটি শরীয়ত নির্দেশ দিয়েছে। কারণ হলো যেন রাত্রে উঠে এবাদত করা যায়। উল্লেখ্য যে, বাম কাঁধে শোয়া সম্পর্কটা শরীরের সাথে আর ডান কাঁধের সম্পর্কটা অন্তরের সাথে হয়ে থাকে। (সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ)।
পেটের ভরে না ঘুমানো
পেটের ভরে শয়ন করা যাবে না। কেননা পেটের ভরে শয়ন হলো জাহান্নামীদের শয়ন।
ان النبي صلى الله عليه وسلم قال انها ضجعة اهل النار وقال انها ضجعة لا يحبها الله عز وجل
অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পেটের ভরে শয়ন করা এটা জাহান্নামীদের শয়ন, তিনি আরো বলেন এই শয়ন আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন না। (মস্তাদেরাকে হাকেম হা ৪/২৭১)।
রাত্রে উঠে ইবাদত করার নিয়তে ঘুমানো
প্রত্যেকের জন্য উচিত রাত্রে কিছু না কিছুই এবাদত করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার পূর্বের ওপরের গুলোসমূহ আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, এরপরেও তিনি রাত্রে অনেকক্ষণ ধরে এবাদত করতেন।
عن عائشه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يقوم من الليل حتى تتفطر قدماه
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ রাত্রে এবাদত এত দীর্ঘক্ষন ধরে করতেন যার কারণে তার পা ফুলে যেত। (বুখারী হা/৩৭৪৮, মুসলিম হা/২৮২০)।
عن ابي الدرداء ان النبي صلى الله عليه وسلم قال من اتى الى فراشه وهو ان ينوى ان يقوم فيه صلى من الليل فغلبته عينه حتى يصبح كانت له ما نوى وكان نومه صدقة من ربه
অর্থাৎ, আবু দারদা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, তোমাদের মধ্যেই যে রাতে ঘুমানোর সময় রাতে উঠে এবাদত করার নিয়তে ঘুমাবে, অতঃপর সে যদি জাগতে না পারে, তাহলে এই নিয়তের কারণে পুরো সওয়াব পেয়ে যাবে। (নাসায়ী ও ইবনে মাজা)।
ঘুমানোর সময় রাসুল সাঃ কর্তৃক বর্ণিত দোয়া গুলো পড়ে ঘুমানো
রাসূলুল্লাহ সঃ ঘুমানোর সময় অনেক দোয়া পড়েছেন যেগুলি পড়ে ঘুমানো উচিত।
হুযাইফা রাঃ বলেন, নবী করীম সাঃ যখন রাত্রে বিছানা গ্রহণ করতেন তখন তিনি তার হাত গালের নিচে রাখতেন। অতঃপর বলতেন,
اللهم باسمك اموت واحيى উচ্চারণ, আল্লাহুম্মা বিইসমিকা আমূতু ওয়া আহয়্যা। অর্থাৎ, হে আল্লাহ আমি তোমার নামে মরছি বা ঘুমাচ্ছি এবং জিন্দাহ হব জাগব। (বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত হা ২৩৬২)।
বারা ইবনে আযেব রঃ বলেন, রাসুল সাঃ যখন ঘুমাতে যেতেন তখন ডান পাশের ওপর ঘুমাতেন। তারপর বলতেন,
اللهم اسلمت نفسي اليك ووجهت وجهي اليك وفوضت امري اليك والجأت ظهري اليك رغبة ورهبة اليك لا ملجأ ولا منجا منك إلا اليك أمنت بكتابك الذي أنزلت وبنبيك الذي أرسلت
উচ্চারণ ঃ আল্লাহুম্মা আসলামতু নাফসি ইলাইকা, ওয়া ওয়াজজাহতু ওয়াজহি ইলায়কা, ওয়া ফাওয়াযতু আমরি ইলায়কা, ওয়া আলজা'তু যহরী ইলায়কা, রগবাতান ওয়া রহবাতান ইলায়কা, লা মালজা, ওয়াদা মানজা মিনকা, আমানতু বি কিতাবিকা আল্লাযি আনযালতা, ওয়া বি নাবিয়্যিকা আল্লাযি আরসালতা।
আবু মাসঊদ আনসারী রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন যে কেউ রাত্রে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করবে তার জন্য আয়াত দুটি যথেষ্ট হবে। (বুখারী ও মুসলিম)।
অত্র হাদিসে রাসূলুল্লাহ সঃ এর বাণী আয়াত দুটি যথেষ্ট হবে এ ব্যাখ্যায় কেউ বলেছেন সারারাত ইবাদত করলে যে নেকি পেত এ আয়াত দুটি পড়ার কারণে তার সওয়াব পাবে। আবার কেউ বলেছেন, উক্ত ব্যক্তির সারারাত বিপদ মুক্ত থাকবে। (সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ)।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রাতে শয্যায় যেতেন, তখন সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক্ব এবং সূরা নাস এই তিনটি পাঠ করতেন। অতঃপর তার দুহাত একত্রিত করে তাতে ফুঁ দিতেন, অতঃপর দু'হাত সম্মুখভাগ হতে শুরু করে সম্ভব পর শরীর মাসাহ করতেন। তিনি এরূপ তিন বার করতেন। (বুখারী ও মুসলিম)।
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন, যদি কেউ শয়ন কালে আয়াতুল কুরসী পাঠ কর, তাহলে শয়তান তার নিকটবর্তী হবে না। (বুখারী ও মুসলিম)।
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা ফাতেমা রাঃ চাক্কি পিসতে তার হাতে যে কষ্ট হয় তা বলার জন্য রাসূলুল্লাহ সাঃ এর নিকটে গেলেন। তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন যে, নবী করিম সাঃ এর নিকট যুদ্ধবন্দি গোলাম এসেছে। কিন্তু তিনি রাসূল সাঃ এর সাক্ষাৎ পেলেন না। তখন আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা এর নিকট তা উল্লেখ করলেন।
অতঃপর রাসূল সাঃ যখন আসলেন তখন আয়েশা রাঃ তাকে এ সংবাদ দিলেন। আলী রাদিয়াল্লাহু কাল হোক বলেন সংবাদ পেয়ে রাসূল সাঃ আমাদের নিকটে আসলেন। তখন আমরা শয্যা গ্রহণ করেছি। আমরা উঠার চেষ্টা করলে তিনি বললেন, তোমরা নিজ নিজ জায়গায় থাকো।
আরো পড়ুনঃ হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
অতঃপর তিনি আমারও তার মধ্যখানে এসে বললেন, যাতে তার পায়ের শীতলতা আমার পেটে অনুভব করলাম, অথবা তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন জিনিসের সংবাদ দিব না যা তোমরা চেয়েছো তা চেয়ে উত্তম হবে?
আর তা হলো, যখন তোমরা শয্যা গ্রহণ করবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলবে। তাহলে এটা তোমাদের চাকর অপেক্ষা উত্তম হবে। (বুখারী ও মুসলিম)। অতঃপর আমরা এটাও আমল করতে পারি।
শেষ কথাঃ
পরিশেষে বলা যায়, ঘুম আল্লাহর একটি বড় নিয়ামত, এর শুকরিয়া আদায় করা একান্ত জরুরী। আল্লাহ তা'আলা যেন আমাদেরকে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি আমল করার তৌফিক দান করেন, আমিন। আরো এমন ব্লগ পেতে সাথেই থাকুন!
আব্দুন নূর আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url